পিরোজপুরের ভাসমান হাট তরমুজের স্বর্গরাজ্য

বিদেশের ফ্লোটিং মার্কেটের মতোই বাংলাদেশেও রয়েছে ভাসমান বাজার। যেখানে সবকিছু বিক্রি হয় ভাসমান নৌকায়। পাঁচ টাকার চা-পান থেকে শুরু করে ধান, চাল, সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই ভাসমানভাবে বিক্রি হয় এই বাজারে। এমন মনোরম দৃশ্য দেখা যায় পিরোজপুরের নাজিরপুরের ‘বৈঠাকাটা ভাসমান বাজারে’।
দেশের সৌন্দর্যমণ্ডিত জেলা পিরোজপুরের সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার এই বৈঠাকাটা। নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বেলুয়া নদীর মোহনায় এই বাজার প্রতিষ্ঠিত। তিন জেলার (গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও বরিশাল) মিলনস্থলে অবস্থিত এই নদীতে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে ভাসমান হাট। আগের রাত থেকেই খাল বেয়ে চিতলমারী, মোড়েলগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা ডিঙি নৌকা বা ট্রলারে করে ভিড়তে থাকেন নাজিরপুরে। ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যেই সরগরম হয়ে ওঠে বাজার। অন্যান্য বাজারের মতো এখানে ক্রেতা-বিক্রেতারা কেউই পায়ে হেঁটে বা গাড়িতে আসেন না; এই বাজারে সবাই আসেন নৌকায়। স্বাভাবিক সময়ে ভোর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে হাট।
ভৌগোলিকভাবে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার পুরোটাই নদী আর খালবেষ্টিত। পানির ওপর ভাসমানভাবে সবজি ও সবজির চারা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত এই এলাকা। কৃষকের উৎপাদিত সবজি ও বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য কেনাবেচার জন্য পাকিস্তান আমলে বৈঠাকাটা বাজারের সূত্রপাত। তবে কারো কারো মতে, এই বাজারের বয়স আরও বেশি। প্রতি বছর তরমুজের মৌসুমে এই হাটে তরমুজ বেচাকেনার ধুম পড়ে। মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত চলে এই বেচাকেনা। ঢাকা, খুলনা, যশোর, নরসিংদী, উত্তরাঞ্চল, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এই হাটে তরমুজ কিনতে আসেন। স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা তাঁদের কাছে তরমুজ বিক্রি করে ভালো দাম পান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেলুয়া নদীতে ভাসমান বাজারে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০ থেকে ৫০টি ট্রলার বোঝাই করে হাটে তরমুজ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। পটুয়াখালী, চরফ্যাশন, বরগুনার ট্রলারের সংখ্যাই বেশি। অনেক ব্যবসায়ী আবার ট্রলার পাঠিয়ে শ্রমিকদের মাধ্যমে তরমুজ বিক্রি করছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা ট্রলারে উঠে দরদাম করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে সরগরম তরমুজের হাট। দামে বনিবনা হলে ট্রলার থেকে তরমুজ কিনে অন্য ট্রলারে তোলা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ট্রলার থেকে তরমুজ কিনে ছোট নৌকায় তুলছেন। অনেক ব্যবসায়ী ট্রলার থেকে তরমুজ কিনে পাশের বৈঠাকাটা বাজারে রাখা ট্রাকেও বোঝাই করছেন।

খুলনার কয়রা উপজেলা থেকে তরমুজের খেত কিনে পাইকারি দরে ভাসমান বাজারে তরমুজ বিক্রি করতে আসা ষাটোর্ধ্ব মোতাহার আলী বলেন, উপকূলীয় জেলাগুলোর চরাঞ্চলে প্রচুর তরমুজ আবাদ হচ্ছে। তারা খেত হিসেবে তরমুজ কেনেন। প্রতি বিঘা খেতের দাম ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১২ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত পড়ে। এরপর ক্ষেত থেকে তরমুজ কেটে আকারভেদে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন। পাইকারি বাজারে শত (১০০টি) হিসেবে তরমুজ বিক্রি হয়। এ বছর ৫ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন এবং এখনও আরও খেত বাকি আছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার লাভ ভালো পাচ্ছেন।
বৈঠাকাটা বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মো. আলমগীর হোসেন জানান, ভোলার চরফ্যাশন, পটুয়াখালী, বরগুনার বিভিন্ন চরে আবাদ করা তরমুজের খেত কেনেন ব্যবসায়ীরা। এরপর ক্ষেত থেকে পাকা তরমুজ ট্রলারে করে বৈঠাকাটাসহ বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হয়। বড় আকারের ১০০টি তরমুজের পাইকারি মূল্য ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা, মাঝারি আকারের তরমুজ ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা এবং ছোট তরমুজ আকারভেদে পাঁচ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। হাট থেকে তরমুজ স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বড় ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। পাশাপাশি অনেক সিজনি তরমুজ বিক্রেতাও আসেন এই বাজারে এবং এখান থেকে তরমুজ কিনে বেশি লাভবান হন।
এই হাট থেকে তরমুজ কিনে নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী নেছারাবাদ উপজেলার ব্যবসায়ী ওমর আলী। তিনি জানান, প্রতি হাটে কয়েক কোটি টাকার তরমুজ কেনাবেচা হয় এখানে। তিনিও এ বছর এখান থেকে প্রায় চার কোটি টাকার তরমুজ কিনে বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি বিক্রি করেছেন। গত বছর দাম চড়া থাকলেও মাল খারাপ ছিল, তবে এবার দাম মোটামুটি এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মাল ভালো। চাহিদাও বেশি।