চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৮৩৭ ভুল তথ্য শনাক্ত : রিউমর স্ক্যানার

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে প্রচারিত ৮৩৭ ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ৬৫৪টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছিল। জাতীয়, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়ে যাওয়ায় এই বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। আগের প্রান্তিকের (২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় এই হার প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। শনিবার (২৬ এপ্রিল) গণমাধ্যমে পাঠানো রিউমর স্ক্যানারের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ফেসবুক ভুয়া তথ্যের প্রধান উৎস
বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৭৪৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে আটটির বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। ফেসবুকের পরেই একক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে এক্স (১৬২টি)। এছাড়া ইউটিউবে ১২৪টি এবং টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে ৬৭টি করে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও ৪২টি ভুল তথ্য, ছবি ও ভিডিও সম্বলিত প্রতিবেদন শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। পাশাপাশি, ভারতীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২০টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
রাজনৈতিক অপতথ্য বৃদ্ধি
আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে, যার আভাস চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই পাওয়া গেছে। এই সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে ৩৪৬টি (মোটের প্রায় ৪১ শতাংশ) ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার, যা ক্যাটাগরি হিসেবে সর্বোচ্চ। জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে ২৯ শতাংশ এবং ধর্মীয় বিষয়ে ৯ শতাংশ ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। তবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে গত প্রান্তিকের তুলনায় ভুল তথ্যের প্রচারের হার কিছুটা কমেছে।
জামায়াত ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সর্বাধিক গুজব
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি (৮১টি) ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সর্বাধিক ভুল তথ্যের শিকার হয়েছেন, যেখানে তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জামায়াতের পরেই আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে সর্বাধিক (২৮টি দলের নামে এবং ১১৫টি নেতাকর্মীদের নামে) ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে প্রচারিত ভুল তথ্যের ৮০ শতাংশই ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিএনপিকে জড়িয়ে আটটি এবং দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জড়িয়ে সর্বাধিক নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের নামে তিন মাসে ৪৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে একই সময়ে ছয়টি (৮৩ শতাংশই ইতিবাচক উপস্থাপন) ভুয়া তথ্যের প্রচার দেখা গেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। দলটিকে জড়িয়ে প্রথম প্রান্তিকে দুটি ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া দলটির নেতাদের জড়িয়ে এই সময়ের মধ্যে প্রচার হওয়া ২০টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
গেল বছর কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের সময়টায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন। এ বছরের প্রথম তিন মাসে সংগঠনটিকে জড়িয়ে ২০টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে একই সময়ে ৩০টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকে নিয়ে ১০টি করে, খান তালাত মাহমুদ রাফি ও নুসরাত তাবাসসুমকে জড়িয়ে তিনটি করে এবং হাসিব আল ইসলাম, তিলোত্তমা ইতি, উমামা ফাতেমা ও আব্দুল হান্নান মাসউদকে জড়িয়ে একটি করে ভুল তথ্য প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ধারাবাহিক অপপ্রচার
গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশে সাধারণত যে দল বা ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থাকে সে দল বা ব্যক্তিদের বিভিন্ন কার্যক্রমের দরুন তাদের নিয়ে অপতথ্য ছড়ায় বেশি। একইভাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়েও ধারাবাহিকভাবে ভুল তথ্যের প্রচার হয়ে আসছে। গেল বছর এই সরকারকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ১৩৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ছড়ায় ১১০টি ভুল তথ্য। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এই সরকারকে জড়িয়ে ৪৪টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এসবের মধ্যে ৯৩ শতাংশ ভুয়া তথ্যের উপস্থাপনই ছিল সরকারের জন্য নেতিবাচক। এছাড়া, গেল তিন মাসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ৫১টি ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবমিলিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ১৭৯টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। একই সময়ে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে ১৬১টি ভুল তথ্য।
এছাড়া এই সরকারের নয়জন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে গেল তিন মাসে সর্বমোট ৩৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
ভুয়া তথ্যের নিয়মিত শিকার হয়ে উঠেছে বাহিনীগুলো
দেশে সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জড়িয়ে এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৬০টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ ৪২টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। বাহিনীটির বর্তমান প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে ১১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে ১২টি, ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে নিয়ে একটি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) নিয়ে একটি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) নিয়ে তিনটি, এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে নিয়ে প্রচারিত দুটি করে ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷
ধর্ম, বিনোদন ও খেলায় কমেছে ভুল তথ্য
ভুল তথ্যের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ধর্ম সংক্রান্ত নানা বিষয়। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিয়মিতই ছড়াচ্ছে নানা গুজব। চলতি বছর প্রথম তিন মাসে ধর্মভিত্তিক ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে ৭২টি। মার্চে পবিত্র রমজান এবং এপ্রিলে মুসলিমদের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে যথাক্রমে ১৮ ও ছয়টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে৷
প্রথম প্রান্তিকে ক্রীড়াঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া ২৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। প্রচারিত এসব ভুল তথ্যের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন তামিম ইকবাল (ছয়টি)। পরের দুই অবস্থানে আছেন নাজমুল হোসেন শান্ত (চারটি)।
বিনোদন জগতে বিভিন্ন বিষয়ে গুঞ্জন আর ধোঁয়াশা লেগেই থাকে সবসময়। তবে গেল কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর এই ক্ষেত্রটিতে ভুয়া তথ্যের প্রচার হ্রাস পেয়েছে বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এই অঙ্গনকে ঘিরে প্রচারিত ২৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
জাতীয় রাজনৈতিক নানান ইস্যু, সঙ্গী ভুল তথ্যও
মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গত ৬ মার্চ আট বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ করে শিশুটির পরিবার। শিশুটির পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রান্তিকে অন্তত আটটি ভুয়া তথ্যের প্রচার দেখা গেছে। এই সময়ের মধ্যে একক ইস্যু হিসেবে এই বিষয়েই বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে, সংখ্যায় যা অন্তত ৩৬টি।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাসভবনে এক দল বিক্ষুব্ধ লোক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়। একপর্যায়ে এক্সকেভেটর দিয়ে বাড়িটি ভাঙা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্তত ১১টি অপতথ্যের প্রচার ছিল এই তিন মাসে।
দেশে চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকে সময়ে সময়ে নানান ইস্যুতে সরগরম ছিল ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যম। এমন ২৩টি ইস্যুতে ১৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে৷
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বিদেশি সরকার প্রধান ও সরকারের নানা পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় কর্তাদের জড়িয়ে বাংলাদেশে অপতথ্যের প্রচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বছর প্রথম প্রান্তিকে এমন কিছু ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জড়িয়ে ২১টি, মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডকে জড়িয়ে আটটি, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) প্রধান ইলন মাস্ককে জড়িয়ে চারটি, কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে জড়িয়ে একটি অপতথ্যের প্রচার দেখা গেছে। এছাড়া, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জড়িয়ে সাতটি এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে জড়িয়ে একটি অপতথ্যের প্রচার লক্ষ্য করা গেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বাইরে জাতিসংঘকে জড়িয়ে সাতটি, সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে জড়িয়ে একটি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জড়িয়ে একটি ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
এআই ও ডিপফেক
এআই ও ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি আটটি ভুল ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে। যার শিকার হয়েছেন রাজনৈতিক এবং বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন ব্যক্তি।
ভারতীয় গণমাধ্যম
ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারতীয় অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপপ্রচার অব্যাহত রয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কিত ২০টি ঘটনায় ভারতের ২৩টি সংবাদমাধ্যমে ৩৮টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
দেশের গণমাধ্যম
ক্রমাগত শিকার বানানো হচ্ছে গণমাধ্যমকে। গণমাধ্যমের নাম ও লোগো ব্যবহার করে ১৩৫টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যেখানে যমুনা টিভির নাম সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে।