স্বপ্নের খেজুর চারায় দক্ষিণাঞ্চলে নতুন সম্ভাবনা

জীবিকার তাগিদে ২০১৮ সালে বাহরাইনে পাড়ি দিয়েছিলেন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের নরহরকাটি গ্রামের কৃষক শেখ শোকর আলী। উদ্দেশ্য ছিল বেশি আয়, পরিবারে সচ্ছলতা আনা। কিন্তু সে যাত্রায় শুধু অর্থই নয়, সঙ্গে করে ফিরিয়ে আনেন এক নতুন সম্ভাবনার বীজও।
বাহরাইনের খেজুর বাগানে কাজ করতে গিয়েই শেখ শোকর আলী উপলব্ধি করেন, খেজুর একটি লাভজনক ও টেকসই ফসল, যা উষ্ণ ও খরাপ্রবণ জলবায়ুতে ভালো জন্মায়। দেশে মাটি ও পানির গুণাগুণ বিচার করে তার মনে জন্ম নেয় এক নতুন স্বপ্ন—নিজ দেশে উন্নত জাতের খেজুর চাষের।
২০২১ সালে দেশে ফেরার সময় শোকর আলী সঙ্গে আনেন প্রায় ৫০টি উন্নত জাতের খেজুর বীজ। নিজ বাড়ির আঙিনায় সেই বীজ থেকে চারা তৈরি শুরু করেন। প্রবাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রথম দফায় সফল চারা উৎপাদনের পর, ২০২২ সালে তার দুই ছেলের একজনকে পাঠান বাহরাইন ও অন্যজনকে সৌদি আরবে। তাদের মাধ্যমে আরও ৮টি উন্নত জাতের খেজুর বীজ সংগ্রহ করেন তিনি। বর্তমানে তার নার্সারিতে রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার খেজুর চারা। কিছু গাছে ইতোমধ্যেই ফল আসতে শুরু করেছে। কয়েকটি গাছে ঝুলছে খেজুরের ‘কাধি’ বা ফলগুচ্ছ। তার এই সফলতা দেখতে প্রতিদিনই অনেক উৎসাহী কৃষক ভিড় করছেন শোকর আলীর বাড়িতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট) লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণতার কারণে যেখানে প্রচলিত ফসল চাষে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেখানে খেজুর হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প। খেজুর গাছ লবণ সহ্য করতে পারে এবং অতিরিক্ত পানি ছাড়াই টিকে থাকতে সক্ষম।
কালিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওয়াশিম উদ্দিন বলেন, শোকর আলীর নার্সারিতে উন্নত জাতের কয়েক হাজার খেজুর চারা রয়েছে এবং কিছু গাছে ইতোমধ্যে চমৎকার ফলন দেখা গেছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ইঙ্গিত। এখন পরীক্ষামূলকভাবে আরও বিস্তৃত পরিসরে চাষ করে কার্যকারিতা যাচাই করা যেতে পারে। সফল হলে সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষকদের খেজুর চাষে আগ্রহী করে তোলা যাবে।
একই উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের শমশের গাজীর ছেলে শফিউল্লাহও চার বছর আগে সৌদি আরব থেকে খেজুরের বীজ সংগ্রহ করে নিজ উদ্যোগে চারা তৈরি করেন। এরপর সেসব চারা রোপণ করেন গলঘেসিয়া নদীর তীরঘেঁষে থাকা নিজের লবণাক্ত জমির চিংড়িঘেরের বাঁধে। শুরুতে আশঙ্কা থাকলেও সময়ের সঙ্গে দেখা যায় তার উদ্যোগও সাফল্যের মুখ দেখেছে। যদিও রোপিত গাছগুলোর বেশিরভাগই পুরুষ গাছ, তবে দুটি মেয়ে গাছ থেকে এখন তিনি খেজুর পাচ্ছেন। বর্তমানে তার গাছগুলোতেও ঝুলছে খেজুরের ‘কাধি’ বা ছড়াসমূহ, যা আশার আলো জাগিয়েছে বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কৃষিবিদ আমজাদ হোসেন বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও পানির বৈশিষ্ট্য স্থানভেদে ভিন্ন। তবে খেজুর একটি তুলনামূলকভাবে খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ছোট পরিসরে বিভিন্ন এলাকায় খেজুর চাষ করে উপযোগিতা যাচাই করা যেতে পারে। যদি এসব পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়, তবে পরিকল্পিতভাবে বড় পরিসরে খেজুর চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল খেজুর আমদানি করতে হয়, বিশেষত রমজান মাসে। দেশেই উন্নত জাতের খেজুর উৎপাদন শুরু হলে তা আমদানি নির্ভরতা কমাবে এবং স্থানীয় কৃষকদের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ।
শোকর আলীর একান্ত প্রচেষ্টায় যেভাবে একটি অজপাড়া গ্রামে সম্ভাবনার চারা গজিয়ে উঠেছে, তা যদি সরকারি গবেষণা, প্রযুক্তি সহায়তা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের আওতায় আনা যায়—তবে দেশের কৃষিতে খেজুর একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।