করের আওতা বাড়িয়ে ব্যবস্থাপনাকে হয়রানিমুক্ত করার তাগিদ এফবিসিসিআইয়ের
ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসন নিশ্চিত করাকে, বাজেট বাস্তবায়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে এফবিসিসিআই। শনিবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি- আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে যথাযথ নজরদারির তাগিদ দিয়েছে।
শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই আইকন ভবনে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পর্যালোচনা সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে প্রস্তাবিত বাজেটকে বিনিয়োগবান্ধব হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এফবিসিসিআই। তবে করের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর ব্যবস্থাপনাকে হয়রানিমুক্ত করার তাগিদ দিয়েছে সংগঠনটি। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বাজেটে আরো প্রণোদনা থাকা উচিত ছিল জানিয়ে এফবিসিসিআই নেতারা এসএমই খাতে সরকারকে নজর দেওয়ার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে, দেশের জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকারও প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বাজেট বাস্তবায়নের চিরায়ত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়। এ সব ক্ষেত্রে প্রশাসনিক এবং নির্বাহী দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং তদারকির মান ক্রমাগতভাবে উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাজেটে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় অর্থনৈতিক পুর্নগঠন, ভ্যাক্সিনেশন ও স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম জোরদারকরণ, কৃষি, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি ২০৩০), প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১), ডেল্টা প্ল্যান, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গৃহিত কার্যক্রম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় বাজেট প্রণীত হয়েছে। কোভিড-১৯ জনিত কারণে কর্মহীনতা ও আয়হ্রাস কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাবৃদ্ধি করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি প্রভৃতির আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে যা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে। এ সব অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) আরও ভূমিকা রাখবে। পিপিপির ওপর বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব আদয়ের লক্ষ্যমাত্রা তেমন বৃদ্ধি করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে তিন লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা যা গত বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার (৩ লক্ষ ১ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় মাত্র ৯.৬৩ শতাংশ বেশি। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেটেড ও অটোমেশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো প্রতিষ্ঠানে মোট জনবলের ১০ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হলে কর রেয়াত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে যা একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি রাখা হয়েছে দুই লক্ষ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে এক লক্ষ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। তবে ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাসম্ভব স্বল্প সুদে বিশেষ স্থানীয় বন্ড এবং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের প্রচেষ্টা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
জসিম উদ্দিন বলেন, খাতভিত্তিক বাণিজ্য সংগঠনসমূহের বিরাজমান অন্যান্য সমস্যাগুলো নিরসন করা জরুরি। অন্যথায় ব্যবসা-বাণিজ্য নীতিমালার ক্ষেত্রে খাতওয়ারি অসংগতি থেকে যাবে। এ সব বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের আমদানি শুল্ক, মুসক ও আয়কর সংক্রান্ত বিশেষ কয়েকটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে বিরাজমান খাতওয়ারি অসংগতি দূরীভূত হবে। এ সব বিশেষ প্রস্তাবাবলি বাজেটে সন্নিবেশ করার জন্য আগামীতে সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সর্বমোট প্রাপ্তি তিন কোটি টাকা বা ততোধিক হলে ব্যক্তি আয়কর দাতাদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম করের হার ০.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.২৫ শতাংশ করা হয়েছে। সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ন্যূনতম করের হার ০.২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি। অগ্রিম আয়কর ব্যবসায়িক খরচ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে এফবিসিসিআই থেকে বিদ্যমান পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছিল। কারণ আমরা নিশ্চিত নই যে, ব্যবসা থেকে ব্যবসায়ীরা বছর শেষে লাভবান হবেন কিনা। অথচ বাজেটে ২০ শতাংশ পর্যন্ত সর্বোচ্চ অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে, এতো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এই অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের জন্য আমরা পুনরায় অনুরোধ জানাচ্ছি। সব ধরনের উৎস কর ও অগ্রিম কর চূড়ান্ত কর হিসেবে সমন্বয় করা জরুরি।
আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (এটি) ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার জন্য এফবিসিসিআই থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। আগাম করের কারণে ব্যবসায়িক খরচ বৃদ্ধি পায় বিধায় আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার প্রস্তাব করছি।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, সফটওয়্যার অথবা আইটি সেবা বিক্রির মাধ্যমে আয়ের ওপর যে ট্যাক্স অব্যাহতি ছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আইটি সেক্টরের বিকাশের লক্ষ্যে এই সুবিধা পুনর্বহাল করার প্রস্তাব করছি। কমপ্লায়েন্স সৃষ্টি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আগামী এক বছরের জন্য ই-কমার্সকে উৎসে করের আওতা বহির্ভূত রাখার প্রস্তাব করছি। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং নৌ-পরিবহণ সহজলভ্য করতে এবং সরকারের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে ড্রেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত কাটার সেকশন ড্রেজারকে ক্যাপিটাল মেশিনারি হিসেবে ১ শতাংশ শুল্কে আমদানির সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। এতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আয়ের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ আয়কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছি। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করার জন্য সব উপজেলা পর্যায়ে আয়কর ও ভ্যাট অফিস স্থাপন করার মাধ্যমে নেট বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করছি। এখন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের কাজে টিন নম্বর ব্যবহার করা হয়। আমরা মনে করি টিন নম্বরের পাশাপাশি ট্যাক্স পেমেন্টের প্রমাণ বা ডকুমেন্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাতে করে সক্ষম কর প্রদানকারীরা রাজস্ব প্রদানে এগিয়ে আসে এবং নিয়মিত কর প্রদানকারীদের ওপর চাপ কমে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিদ্যমান মন্দা পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশের তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য শুল্ক ও কর কাঠামো সংস্কার করে একটি জনবান্ধব, বিনিয়োগবান্ধব এবং উৎপাদনশীল রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পলিসি উইং এবং বাজেট বাস্তবায়ন উইংকে পৃথক করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
জসিম উদ্দিন বলেন, গতকাল বাজেট বিষয়ক প্রেস কনফারেন্সে মাননীয় অর্থমন্ত্রী সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। সেইসঙ্গে মূল্য সংযোজন কর আইন আরো সহজীকরণের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। মূল্য সংযোজন কর আইন সহজীকরণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং এফবিসিসিআইয়ের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো সুদৃঢ় করতে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নে জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো উদ্যোগে বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছি। প্রস্তাবিত বাজেট আমরা আরও বিশ্লেষণ করছি। এফবিসিসিআইর অধিভুক্ত চেম্বার/অ্যাসোসিয়েশনের মতামতের ভিত্তিতে আমাদের বাজেট পরবর্তী বিস্তারিত প্রস্তাবনা সরকারের কাছে উপস্থাপন করব।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহসভাপতি এম এ মোমেন, মো. আমিন হেলালী, মো. হাবিব উল্লাহ ডন, সালাউদ্দিন আলমগীর, এম.এ. রাজ্জাক খানসহ ২০২১-২৩ বোর্ডের পরিচালকবৃন্দ। আরও উপস্থিত ছিলেন ডিসিসিআইয়ের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, এমসিসিআই ঢাকার সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির, বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বিপিজিএমইএর সভাপতি শামীম আহমেদ, বারভিডার সভাপতি আব্দুল হক, ই-ক্যাবের সভাপতি শমী কায়সারসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।