হাজারীবাগে কাঁচা চামড়ার প্রবেশ বন্ধ, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
সরকারি নিষেধাজ্ঞায় রাজধানীর হাজারীবাগের কারখানাগুলোতে গতকাল শুক্রবার থেকে কাঁচা চামড়ার প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্তে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কারখানার মালিকরা বলছেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরে মালিকদের আন্তরিকতার কমতি নেই। সব প্রস্তুতি শেষের পথে। কারখানা স্থানান্তর সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিছু বিষয়ে কারখানা মালিকদের উদাসীনতা থাকলেও তা কেটে গেছে। আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই অধিকাংশ কারখানা স্থানান্তর হবে। এমন অবস্থায় সরকারের আকস্মিক সিদ্ধান্তে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কারখানার মালিকরা।
চামড়া কারখানা স্থানান্তরে গত জানুয়ারি মাসে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। এই সময়সীমা আরো দুই মেয়াদে বাড়ানো হয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেওয়ার পরও হাজারীবাগের কারখানাগুলো স্থানান্তর হয়নি।
গত ২০ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভায় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর দূষণ রোধ-সংক্রান্ত সভায় হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ঘোষণা অনুযায়ী ১ এপ্রিল থেকে যাতে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ না পারে সে জন্য হাজারীবাগের কারখানাগুলোর প্রবেশ পথগুলোতে পুলিশ টহল দিচ্ছে।
হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আলিমুজ্জামান বলেন, ‘শুক্রবার থেকে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ রোধে চারটি পথে ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। টহল পুলিশও সর্বত্র নজর রাখছে। গতকাল রাত পর্যন্ত এ এলাকায় কোনো চামড়া ঢোকেনি। চামড়ার ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আগের মজুদ করা চামড়ার ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই করে কিছু চামড়া খালাশ করতে দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘চামড়া খাতের এ দুর্যোগময় সময়ে এমন ঘটনা অনাঙ্ক্ষিত। এতে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হতে পারে। এমন স্থানান্তরের প্রস্তুতি হিসেবে রপ্তানির অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করে ট্যানারিগুলো খালি করা হচ্ছে। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের ফলে শ্রমিকরাও কর্মহীন বসে থাকবে। কিন্তু তাদের বেতন চলবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ট্যানারি মালিকরা।’
নতুন চামড়া শিল্পনগরীতে ভবন নির্মাণের অগ্রগতি নিয়ে সাখাওয়াত বলেন, ‘ভবন নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। জুন-জুলাইয়ের মধ্যে অধিকাংশ ট্যানারি হেমায়েতপুরে চলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ হাইড স্ক্রিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. আফতাব বলেন, ‘সরকারের এমন সিদ্ধান্ত আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সমস্যার সমাধানে আমরা (ব্যবসায়ীরা) বৈঠকে বসবো। এর করণীয় ঠিক করে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করব।’
সাখাওয়াত আরো বলেন, ‘হাজারীবাগের চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য জুনের শেষ নাগাদ সময় চাওয়া হবে সরকারের কাছে। এর মধ্যে বেশ কিছু কারখানা হেমায়েতপুরে চলে যাবে। বাকিগুলো স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় থাকবে। জুলাইয়ের আগে পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়। ট্যানারিশিল্প সাভারে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আমরা আন্তরিক। কিন্তু হুটহাট করে কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা আমাদের ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। সারাদেশে আগের প্রায় এক লাখ পিস চামড়া মজুদ আছে। এ চামড়া নষ্ট হলে ট্যানারিগুলোর বিশাল লোকসান হবে। এমনকি কাঁচামালেরও সংকট দেখা দেবে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচা চামড়া প্রবেশের বাধায় কারখানাগুলোর কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। আর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বিপুল চামড়া মজুদ রয়েছে। তা নিয়েও দুশ্চিন্তা করছেন তারা। সাভারের নির্মাণাধীন শিল্পনগরীতে কাজ শেষ না হলে সেখানে চামড়া নেওয়া সম্ভব নয়। এতে একদিকে লবণজাত চামড়া নষ্ট ও অন্যদিকে ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে বলে দুশ্চিন্তা করছেন তাঁরা।
বিটিআই ট্যানারির স্বাত্বাধিকারী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরাও চাই ট্যানারিগুলো পরিকল্পিত জায়গাতে যাক। সাভারে ভবন নির্মাণে এত দিন ট্যানারি মালিকদের মধ্যে গরিমসি ছিল। তবে এখন ভবন নির্মাণের কাজ পুরোদমে চলছে।’
ফরহাদ বলেন, ‘সাভারে যাদের ভবন নির্মাণকাজ এগিয়ে আছে তারা এরই মধ্যে হাজারীবাগের চামড়া প্রক্রিয়াকরণের কাজ স্থগিত রেখেছেন। চামড়া সেক্টর এমনিতেই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। শেষ মুহূর্তে এসে সরকারের মন্ত্রীদের দিকনির্দেশনাহীন হঠাৎ হঠাৎ বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত।’
জানা গেছে, হাজারীবাগে স্থানীয় ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সাভার শিল্পনগরীতে ১৫৫টি ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হবে। এরই মধ্যে ৩০টি কারখানার কাজ শেষের পথে। ১১৩টির প্রতিষ্ঠানের কারখানার নির্মাণকাজ চলছে। আইনি জটিলতায় ১২টি ট্যানারির কাজ বন্ধ আছে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার শেষে দ্রুত এসব ট্যানারির কারখানার নির্মাণকাজও শুরু হবে।
রাজধানীর পরিবেশ ও নদীর দূষণ রোধে ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের অনুমোদন হয়। প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জায়গায় ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তত্ত্বাবধায়নে ২০০৭ সালে প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তারপর নানা জটিলতায় ২০১৩ সালে কারখানা নির্মাণে নকশা অনুমোদন দিলেও এখনো এর কাজ শেষ হয়নি।