বর্ষবরণে দেশে ৩৫০ টন ইলিশের মজুদ!
নববর্ষ বরণে দেশের মানুষের উৎসাহের যেন শেষ নেই! সমানতালে চলছে প্রস্তুতি ও কেনাকাটা। এ উপলক্ষে বিচিত্র অনুষঙ্গও যোগ হচ্ছে। যেমন যোগ হয়েছে ইলিশ! আর এর জোগান দিচ্ছেন সারা দেশের মাছ ব্যবসায়ীরা।
পহেলা বৈশাখে ইলিশের জোগান দিতে দেশের বিভিন্ন জেলার হিমাগার মালিক ও আড়তদারদেরও প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক। তাঁদের ধারণা, দেশে গত তিন মাসে আনুমানিক ৩৫০ টন ইলিশ মজুদ করা হয়। তবে গত বছর এর চেয়ে বেশি মজুদ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও বরিশালের মাছ ব্যবসায়ী শেখ আবদুল জব্বার বলেন, পহেলা বৈশাখ ঘিরে দেশে আনুমানিক সাড়ে ৩০০ টন ইলিশ মজুদ করা হয়েছে। তবে গত বছর এর চেয়ে ৪০-৫০ টন বেশি ইলিশ মজুদ করা হয়েছিল। গত ২০-২৫ দিনে মিয়ানমার থেকে প্রায় ৪০ টন ইলিশ আমদানি করা হয়েছে। বরিশালের মজুদ প্রায় শেষের দিকে। প্রতিটি আড়ত থেকে প্রতিদিন দু-তিন টন ইলিশ ঢাকায় যায়।
বরিশালের ইলিশ মজুদকারী প্রতিষ্ঠান লুৎফা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন বলেন, পহেলা বৈশাখে ইলিশ সরবরাহের জন্য জানুয়ারি থেকেই প্রস্তুতি নেন আড়তদার ও হিমাগার মালিকরা। এ মৌসুমে ইলিশ সংরক্ষণের সঠিক হিসাব দেওয়া কঠিন। তবে ইলিশ সংরক্ষণ হয় এমন দেড় শতাধিক হিমাগারে অন্তত ৩৫০ টন ইলিশ মজুদ করা হয়েছে। আর এর ৯৫ শতাংশই দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে পৌঁছে গেছে। গত বছরের তুলনায় এবার মজুদের পরিমাণ কমেছে।
বৈশাখ ঘিরে দেশের ইলিশ মজুদের সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কিংবা মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ সময়ে ইলিশ মজুদের পরিমাণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।
কোথায় কী পরিমাণ মজুদ
বৈশাখ সামনে রেখে দেশের কয়েকটি জেলায় ইলিশ মজুদ হয়েছে। এর মধ্যে ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকায় ইলিশ মজুদ বেশি হয়।
ভোলার ইলিশ মজুদকারী রাসেল বলেন, ‘সারা বছরই ঢাকার বিভিন্ন আড়তে ইলিশ পাইকারি দেওয়া হয়। বৈশাখের মৌসুমেও থাকে বিশেষ প্রস্তুতি। অন্য বছরের তুলনায় এবারের মজুদ কম ছিল। আর এবার মাল অনেকটা আগেই বাজারে চলে গেছে। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় চাহিদার তুলনায় মালের ঘাটতি বেশি।’
চাঁদপুরের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, ‘অন্য বছর চাঁদপুরে বেশি ইলিশ মজুদ হয়। কিন্তু এবার সেখানে খুব বেশি হলেও ২০ টন ইলিশ মজুদ হয়েছে। আমি গত বছর পাঁচ টন ইলিশ মজুদ করেছিলাম। এবার করেছি দেড় টন।’
বরিশালের সব মোকাম মিলে ১৮ থেকে ২০ টন ইলিশ মজুদ করেছে বলে জেলার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
কোন জেলায় কী পরিমাণ সরবরাহ
ভোলার ইলিশ মজুদকারক ও পাইকারি সরবরাহকারী রাসেল হাওলাদার বলেন, এবার ইলিশ শিকার নিষিদ্ধের আগে জানুয়ারির ১০-১২ তারিখ থেকেই ইলিশ সংরক্ষণ শুরু হয়। হিমায়িত ইলিশ পাইকারদের চাহিদা অনুযায়ী সারা দেশে পাঠানো হয়েছে। এর বড় অংশই সরবরাহ হয়েছে রাজধানীতে। মজুদ করা মোট ইলিশের প্রায় ৭০ শতাংশ ঢাকা, ১০ শতাংশ চট্টগ্রাম ও বাকি ২০ শতাংশ দেশের অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করা হয়।
তিন দশকে ইলিশের উৎপাদন
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল এক লাখ ৯১ হাজার টন। এর পরিমাণ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল তিন লাখ ১৩ হাজার টন, ২০১০-১১ অর্থবছরে তিন লাখ ৪০ হাজার টন ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে তিন লাখ ৫১ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিন লাখ ৮৭ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর এর উৎপাদন আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। চাহিদাও বাড়ছে। তবে বৈশাখ ঘিরে এর চাহিদা আরো বাড়ে। এ সুযোগে মাছ ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়।’
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার ‘ইলিশ উন্নয়ন ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান আনিসুর রহমান।
মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ১৪৩টি উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইলিশ ধরা, উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। দেশের মৎস্য খাতে ইলিশ ১১ শতাংশ অবদান রাখে।
যে সময় ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ
গত ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া প্রধান প্রজনন মৌসুম সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও (আশ্বিনের পূর্ণিমা অনুসারে) ১৫ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে।
বৈশাখ ঘিরে মাছের দামে আগুন
রাজধানীর মাছ বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্থান ও দোকান ভেদে ইলিশ ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পাইকারি ও খুচরা ইলিশ বিক্রি হয়। এ বাজারে প্রতিটি দুই কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের বড় আকারের প্রতিটি ইলিশের দাম নয় হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা। এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম দুই হাজার ৭০০ থেকে তিন হাজার টাকা। ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি ইলিশের দাম ৯০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
হাতিরপুল কাঁচাবাজারে প্রতিটি দুই কেজি ওজনের ইলিশ সাড়ে আট হাজার থেকে নয় হাজার টাকা দাম হাঁকা হচ্ছে।
হাতিরপুল বাজারের মাছ ব্যবসায়ী রহিম মুন্সি বলেন, ‘এখন ইলিশের দাম বেশি। মানুষের হাতে টাকা নাই। সবাই ছোট ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ খোঁজে। বড় ইলিশের চাহিদা কম। তবে কিছু নির্দিষ্ট ক্রেতা আছেন যারা আগে থেকেই বড় মাছ কেনার জন্য আদেশ দেন। তাদের কাছে দাম কম-বেশি ব্যাপার না। এমন ক্রেতাকে টার্গেট করেই বড় মাছ আনা হয়।’