কেমন বাজেট চাই অনুষ্ঠানে যা বললেন বক্তারা
কয়েকদিন পরই উপস্থাপন হতে যাচ্ছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। জাতীয় সংসদে এই বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার পাঁচ দিন আগে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো বাৎসরিক নিয়মিত আয়োজন ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠান। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এনটিভির স্টুডিও থেকে আজ শনিবার (২৭ মে) সরাসরি সম্প্রচার হয় এটি। সেখানে আসন্ন অর্থবছরকে সামনে রেখে জনভাবনা, ব্যবসায়ীদের আকাঙ্ক্ষা, সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরবেন মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মূল্যস্ফীতির কথা তুলে ধরেন। বলেন বিনিয়োগ বিমুখী ট্যাক্সেশন পদ্ধতির পরিবর্তন, কর ও করদাতা, শিক্ষা, কৃষি, পর্যটন বিষয়ে। সবার কথায় ফুটে ওঠে—বাজেট হতে হবে এমন, যা বাস্তবায়নযোগ্য।
বিনিয়োগ বিমুখী ট্যাক্সেশন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে : মোহাম্মদ হাতেম
কেএমইয়ের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দাভাবের কারণে অর্ডার কমে যাচ্ছে। এতে করে আর্ন্তজাতিক বাজারে সেল (বিক্রি) কমে যাওয়ায় ব্যাংক লোন সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না, যা অর্ডার দিচ্ছি, তা আনতে পারছি না। গত মাসে আমাদের ১৫ ভাগ গ্রোথ কম হয়েছে।’
বিকেএমইয়ের নির্বাহী সভাপতি বলেন, ‘আমাদের বড় সমস্যা হলো, রিফান্ড করার সুযোগ নেই। সামনের দিনগুলোতেও গ্রোথ আরও কমে আসবে। ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে একভাগ এআইটি নেওয়া হচ্ছে। এতে করে করপোরেট ট্যাক্স আর ১২ ভাগ থাকছে না। আমরা আগে বলতাম লাভ হচ্ছে না, আর এখন চলমান পরিস্থিতিতে বলছি—লোকসান কম হচ্ছে। তাই এআইটি একভাগ বাদ দিতে হবে। এটি কমিয়ে শূণ্য দশমিক ২৫ শতাংশ কমাতে হবে। বাংলাদেশের ট্যাক্সেশন পদ্ধতিটা হলো বিনিয়োগ বিমুখী। তাই ট্যাক্সেশন পদ্ধতিটার পরিবর্তন করতে হবে।’
মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে : পরিকল্পনামন্ত্রী
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও বাজারে টাকা দিয়ে এগুলো কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। বৈশ্বিক কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের সরবরাহ বাড়াতে হবে। আমাদের এ মুহূর্তে চাল ও ডলারের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশে বৈষম্য দৃশ্যমানভাবে বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজেট হতে হবে বাস্তবায়নযোগ্য, সহজ ও জনগণের বোধগম্য। আমাদের দেশে বৈষম্য দৃশ্যমান ভাবেই বাড়ছে। এটাকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাদের আয় নেই, তাদের জন্যই আমাদের সরকার কাজ করছে।’
পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয় : কৃষিমন্ত্রী
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘পেঁয়াজের দাম কমানোর জন্য সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার কৃষকদের যে পরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে, তাতে পেঁয়াজের দাম কোনভাবেই ৫০ থেকে ৬০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।’ তিনি বলেন, ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে অতিথিসহ যারাই বক্তব্য দেন তাদের সকলের বক্তব্য, প্রস্তাবনা ও সুপারিশগুলো লিখিত আকারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পেশ করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।’
কৃষিমন্ত্রী বলেন, আমরা সরকার গঠনের আগে জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিলাম, নির্বাচিত হলে আমরা খাদ্যসামগ্রীর দাম কমিয়ে আনব। দ্রব্যমূল্যকে আমরা জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখব। আমাদের নানামুখি উদ্যোগের কারণে আমাদের কৃষি উৎপাদনও বেড়েছে, কিন্তু চালের দাম বেড়েছে। আমরা কৃষকদের কাছে জানতে চাইলাম, চালের দাম বেশি কেনো? তারা বলছে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আমরা আউশের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকার এক কোটি পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে। এতে কমপক্ষে ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে।’
করদাতাদের ওপর চাপ তৈরি না করে আদায়ের প্রসারতা বাড়াতে হবে : ড. মোস্তাফিজুর রহমান
মূল্যস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে তা এবারের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীন আয় কম। এ কারণে সরকারি যে ব্যয়, তা বৃদ্ধি করতে পারছি না। আমাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে। আমরা আমাদের আমদানিকরকে যৌক্তিক করণ করতে পারতাম। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা যেসব খাত আছে সেটিকে বাড়াতে পারতাম। তাই বলব, অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির সাথে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রেণের সর্ম্পক। আমাদের অস্থিতীশলতার জন্য দায়ী যে সমস্যা অভ্যন্তরীন আয় বাড়াতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনেকরি, যারা ট্যাক্স দিচ্ছে, তাদের ওপর চাপ তৈরি না করে এটা আদায়ের প্রসারতা আরও বাড়াতে হবে। অর্থাৎ, করের জাল বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ট্যাক্স প্রদানকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান হতে পারে।’
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি : এফবিসিসিআই সভাপতি
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, এবারের বাজেটে আমাদের অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে গত ৪০ বছরেও আমরা এমন খারাপ সময় দেখিনি। এই খারাপ অবস্থা শুধু বাংলাদেশে না, সারা পৃথিবীতেই রয়েছে। আমরা যেখানে প্রোডাক্ট বিক্রি করি, তার মধ্যে আমেরিকা, ইউরোপের কনজিউমারদের সেল কমে গেছে ২০ শতাংশ। এখন ডিমান্ড সাইটে যখন সমস্যা হয়, তখন সাপ্লাই সাইটে তো সমস্যা হবেই।’
জসিম উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হয়, আমরা নিম্ন আয় থেকে উচ্চ আয়ে যাচ্ছি। ২০৩০ সালে এসডিসি ও ২০৩১ সালে মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন রয়েছে। এসব বাস্তবায়নে এবারের বাজেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো মাথায় রেখে বাজেট করতে হচ্ছে এবং সাথে আমাদের এবার নির্বাচনকালীন সময়; তাই আমাদের সরকার বিষয়টি মাথায় রাখবেন।’
মো. জসিম আরও বলেন, ‘আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। যুক্তরাজ্যের মতো দেশ রেশনিং করছে। আমাদের কৃষিখাত খুব ভালো করছে। এখানে, ফুড সিকিউরিটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনেক পণ্য আছে, যেগুলো ইমপোর্ট করতে হয়। এরমধ্যে, কৃষিপণ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে যেগুলো ইমপোর্ট করতে হয়, এগুলোর অ্যাডভান্স ট্যাক্স, ভ্যাট অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হবে। আমরা চাই সাধারণ মানুষকে স্বস্তির মধ্যে রাখা, মূল্যস্ফীতি ঠিক রাখা।’
বাজেট হতে হবে বাস্তবায়নযোগ্য : ড. সালেহ উদ্দিন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব সমমস্যাগুলোও প্রকট হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে আরও স্বচ্ছতা আনা জরুরি। ব্যাংক খাতে সংস্কার না হওয়াটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষি, খাদ্য ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’
মদে ভ্যাট কমানোর দাবি টুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের খবির উদ্দিনেররিজম রিসোর্ট অ্যান্ড
ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়শনের সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশি-বিদেশি মদের প্রচুর ভ্যাট ও সম্পূরক ট্যাক্স। এই ভ্যাট ও সম্পূরক ট্যাক্স কমাতে হবে। তিনি বলেন, ‘কেমন বাজেট চাই বললে বলব—ব্যবসা বান্ধব বাজেট চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সেক্টরে বেশি ভাড়া নিই, কারণ প্রতিবছর আমাদের ৫০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটা কমাতে হবে, কিন্তু কমানো হচ্ছে না।’