‘তীব্র চাপ ও কঠিন চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে ইতিহাসের বড় বাজেট
জনগণকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার উপরে জোর দিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দেশীয় অর্থনীতিতে বিদ্যমান তীব্র চাপ ও সম্পদের অপ্রতুলতার মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করেছেন। এবারে অর্থের যোগানের কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন এ অর্থমন্ত্রী সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার এবারের আসন্ন জাতীয় বাজেট ঘোষণা দিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন এই নতুন অর্থমন্ত্রী। ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে তিনি বাজেট ঘোষণা করেছেন।
বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, উন্নত, সমৃদ্ধ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ বছরের নির্বাচনি ইশতেহারে আমরা যে অঙ্গীকার করেছি, সেগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সবার জন্য উপযুক্ত মানুষের জীবনমানের সুরক্ষা, কর্মসংস্থান, কৃষির উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিল্পের প্রসার, উপযুক্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত করা হবে।
এবারের বাজেটে যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা; বিজ্ঞান শিক্ষা; বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবন সহায়ক শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা উন্নত ও সম্প্রসারিতকরণ; তরুণদের প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; সম্ভাব্য সব সেবা ডিজিটালাইজ করাসহ সর্বস্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার; ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ; ২০৩১ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্য নির্মূলকরণ; ২০৪১ সাল নাগাদ সাধারণ দারিদ্র্যের হার তিন শতাংশে নামিয়ে আনা; শিল্প স্থাপন ও বিনিয়োগে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ; জনকল্যাণমুখী, জবাবদিহিতামূলক, দক্ষ ও স্মার্ট প্রশাসন গড়ে তোলা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখা।
দেশের মানুষ আমাদের সব গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের প্রকৃত দাবিদার জানিয়ে বাজেট অর্থমন্ত্রী বলেন, এবারের বাজেটে সর্বোচ্চ থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। থাকছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন ও রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয় দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এবারে ব্যয় হবে সুদ পরিশোধে এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা, ভর্তুকি এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও পেনশন এক লাখ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি মেটাতে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া সুদ পরিশোধে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং দেশের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হচ্ছে আমদানি শুল্ক কাঠামোতে। এবারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর উপায় খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় কিছু প্রস্তাব থাকবে জানান তিনি।
বাজেট প্রতিক্রিয়া
প্রস্তাবিত বাজেটকে সংকটে বাস্তবসম্মত গণমুখী বাজেট বলে অভিহিত করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, সংকটের এই সময়ে গণমুখী বাজেট হয়েছে। দলের নির্বাচনি ইশতেহারে দেওয়া অঙ্গীকার ও অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় নিয়ে বাজেট দেওয়া হয়েছে৷ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও ফোকাসটা থাকবে৷ বাস্তবসম্মত হয়েছে এই বাজেট৷
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এটা লুটেরাদের বাজেট। সরকার লুটেরায় পরিণত হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের এই সংকটকালে সরকার আবার একটা লুট করার পরিকল্পনা করছে। তথাকথিত বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি।’
সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব বাজেট হতে পারে না। কারণ, বাজেটে সাধারণ মানুষের স্বস্তির কোনো কারণ নেই ৷ বাজেটের পর দেশ একটা বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকারের চতুর্থ মেয়াদের প্রথম ঘোষিত বাজেট নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। বাজেট যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি বিবেচনায় সময়োপযোগী বাজেট।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার এমন সুবিধা সৎ ও বৈধ আয়ের ব্যক্তি করদাতাকে নিরুৎসাহিত করার সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি এবং এর আওতায় ঘোষিত অর্থ ও সম্পদের ব্যাপারে কোনো কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন করার সুযোগ না রাখা দেশে দুর্নীতি সহায়ক একটি উদার পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে এই সুযোগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন দলের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার অঙ্গীকার, যা প্রায়শই সরকার প্রধানসহ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পুনরাবৃত্তি করে থাকেন, সেই অঙ্গীকারকে প্রহসনে পরিণত করেছে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির নেতারা বলেছেন, যে সরকার নিজেই সংবিধান লঙ্ঘন করে, প্রশাসন যন্ত্রকে অবৈধভাবে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে, ডামি নির্বাচন নামক প্রহসনের মাধ্যমে জোরপূর্বক গদি দখল করে রাখে, ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে বিচার বিভাগকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেয়... সেরকম রাজনৈতিক বৈধতাবিহীন সরকারের বাজেট কখনোই জনকল্যাণকর হতে পারে না।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী বর্তমান সরকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট পেশ করেছে, তা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।
বাজেটের আকার
আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। তবে চলতি বাজেটে কাঙ্খিত রাজস্ব আহরন না হওয়া সংশোধন করে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। এবারের বাজেটে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সংশোধিত বাজেটে এটি কমে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়।
পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়
আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এই খাতে ব্যয় ধরা হয় ৪ লাখ ৫৩ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এডিপি দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এডিপিসহ মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।
রাজস্ব আহরণ
আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব (এনবিআর) আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া এনবিআরের বহির্ভূত কর থেকে আয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির হার জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি পূরণ-অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা হবে। এর মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণের মাধ্যমে সংস্থান করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে থেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা।