রপ্তানি আয়ের দুই হাজার ৩৩৪ কোটি ডলার কোথায়?
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের হিসাব নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে মিলছে না৷ ইপিবি ২০ মাসে যে হিসাব দিয়েছে, তা থেকে দুই হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের হদিস পাচ্ছে না বালাদেশ ব্যাংক৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি এর আগে কখনো হয়নি৷ এর ফলে অর্থনীতির অনেক হিসাবই এখন পরিবর্তিত হয়ে যাবে৷ ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাব উল্টে যাবে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেও প্রভাব পড়বে৷ প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও পরিবর্তন আসবে৷
রপ্তানি আয়ের হিসাব মিলছে না
ইপিবির হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চার হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়৷ কিন্তু এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল তিন হাজার ৬১৩ কোটি ডলারের৷ তাদের হিসাবে ৯৫৪ কোটি ডলারের রপ্তানি কম হয়েছে৷
আর বিদায়ী অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে ইপিবির হিসাবে চার হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে৷ আর বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের৷ তাদের হিসাবে রপ্তানি এক হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কম৷
বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস এবং এর আগের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস মিলিয়ে মোট ২০ মাসে ৯ হাজার ৩১৪ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল ইপিবি৷ আর বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বলছে, ওই ২০ মাসে রপ্তানি হয়েছে ছয় হাজার ৯৮০ কোটি ডলার৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দুই হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের কম রপ্তানি হয়েছে, যা ইপিবির হিসাবের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম৷ এখন প্রশ্ন হলো, ইপিবির হিসাবের রপ্তানি আয় কোথায় গেল? নাকি, ইপিবি রপ্তানি আয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে?
এ অবস্থায় ব্যালেন্স অব পেমেন্টে (বিওপি) প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ গত মার্চ পর্যন্ত বিওপিতে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দেখানো হয়েছিল মাত্র ৪৭৪ কোটি ডলার৷ কিন্তু এপ্রিলে এসে এ ঘাটতি এক হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার দেখানো হয়েছে৷ এক ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় চার গুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য৷ মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে প্রায় ৫৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হলেও এপ্রিলে এসে সেটি প্রায় ৫৭৩ কোটি ডলারের ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে৷
বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে৷ গত দুই অর্থবছরেই আর্থিক হিসাবের বড় ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক৷ আর মার্চ পর্যন্ত অর্থবছরের ৯ মাসে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি দেখানো হয়েছিল প্রায় ৯২৬ কোটি ডলার৷ কিন্তু এপ্রিলে এসে আর্থিক হিসাবে ২২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে৷ আর এপ্রিল শেষে বিওপির মোট ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৫৬ কোটি ডলার৷
এই পরিস্থিতির কারণ নিয়ে ডয়চে ভেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি৷ তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক দুই দিন আগে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘রপ্তানির তথ্য আমরা ইপিবি থেকে পাই৷ সংস্থাটি এতদিন যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে, সেটির ভিত্তিতেই বিওপির হিসাবায়ন করা হয়েছে৷ ইপিবি এখন রপ্তানির সংশোধিত তথ্য দিয়েছে৷ এক্ষেত্রে কী ঘটেছে, সেটির ব্যাখ্যা ইপিবি দিতে পারবে৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দায় নেই৷’
আর ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেনকে বারবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি৷ তিনি গত কয়েকদিন ধরে সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন বলে জানা গেছে৷
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, তিন কারণে এই পরিস্থিতি হতে পারে৷ প্রথমত, কাস্টমসের মাধ্যমে যে তথ্য নিয়ে ইপিবি হিসাব দিয়েছে, সেখানে তারা ওভার রিপোর্টিং করেছে৷ ১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি দেখানো হয়েছে৷ কিন্তু, বাস্তবে ওটা চার মিলিয়ন ডলারের৷ আসলে ওই পণ্য ওটা এখানে কাটিং করা হয়েছে বা পুরোটা এখানকার পণ্য নয়৷ দ্বিতীয়ত, আরেকটা হতে পারে, যেটা এর আগে পাকিস্তানে হয়েছে৷ তা হলো রপ্তানি বেশি দেখিয়ে রপ্তানিকারকরা সাবসিডির সুবিধা নিয়েছে৷ এখানে রপ্তানিকারক ও কাস্টমস দুই পক্ষই আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকতে পারে৷ তৃতীয়ত, আরেকটা হতে পারে, যে পরিমাণ রপ্তানি করা হয়েছে সেই পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হয়নি৷
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রপ্তানি আয় যদি দেশে আনা না হয়ে থাকে তাহলে সেটা আনা যাবে৷ কিন্তু, অন্য দুই কারণে হয়ে থাকলে তো আর দেশে অর্থ আসবে না৷’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘এর ফলে অর্থনীতির অনেক হিসাবই এখন পাল্টে যাবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা কারেকশন শুরু করেছে৷ আরও আগে করলে ভালো হতো৷ পুরো সিনারিও পাল্টে যাচ্ছে৷ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস ছিল, সেটা হয়ে গেছে নেগেটিভ৷ ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ছিল নেগেটিভ, সেটা হয়ে গেছে পজেটিভ৷’
ড. মনসুর বলেন, ‘এরকম পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি৷ এখন অর্থনীতির অনেক হিসাব নিকাশই উল্টে গেল৷ যে তথ্য উপাত্তের ওপর অর্থনীতির বিশ্লেষণ করা হতো, সেই তথ্যই ঠিক নেই৷ এর এখন একটা তদন্ত হওয়া দরকার৷ এর জন্য কারা দায়ী এবং এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা জানা দরকার৷’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কী কারণে এরকম হয়েছে সেটা তো আমরা বলতে পারব না৷ বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবি বলতে পারবে৷ তারা তদন্ত করে দেখতে পারে৷ শুধু তদন্ত বা এখন কারেকশন করলেই হবে না৷ দায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে৷ ভবিষ্যতে যাতে আর না হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে৷’
‘তবে আমার মনে হয় রপ্তানিকারকরা তো রপ্তানির ওপর নগদ সহায়তা পান৷ হতে পারে সেটা বেশি পাওয়ার জন্য প্রকৃত রপ্তানির চেয়ে বেশি দেখিয়েছে৷ আবার বেশি দেখানোর প্রবণতাও হতে পারে৷ ক্যাশ ইনসেনটিভ, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড থেকে অর্থ নেওয়া—এসব কারণে প্রকৃত রপ্তানির চেয়ে বেশি রপ্তানি দেখানো হতে পারে’, বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর।
সালেহ আহমেদ বলেন, ‘এতে তো এখন অনেক হিসাব বদলে যাচ্ছে৷ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নেগেটিভ হচ্ছে৷ আবার ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট পজেটিভ হচ্ছে৷ এর প্রভাব পড়বে ডলারের ওপর, টাকার অবমূল্যায়ন হবে৷ কম না তো ২৩ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলারের গরমিল৷’
‘মাথাপিছু আয় কমবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘রপ্তানির হিসাবে এই গরমিলের কথা আপনাদের (ডয়চে ভেলে) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমি বেশ আগেই বলেছিলাম৷ শুধু রপ্তানি নয়, আমদানির হিসাবেও ঝামেলা আছে৷ ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ছয় হাজার ৬৮ কোটি ডলার৷ তখন আমাদের উদ্বৃত্ত ছিল ৯২৭ কোটি ডলার৷ কিন্তু পরের অর্থবছরে আমাদের আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়৷ ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি বাবদ ব্যয় দেখানো হলো আট হাজার ২৫০ কোটি ডলার৷ অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে দুই হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি আমদানি করা হয়েছে৷ বাংলাদেশে এমন কী ঘটেছে, এক বছরে আমদানির উল্লম্ফন ঘটল?’
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘অর্থনীতির সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকলে অর্থনীতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না৷ সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া যায় না৷ তবুও ভালো যে বাংলাদেশ ব্যাংক এর কারেকশন শুরু করেছে৷ এর ফলে আমাদের এখন জিডিপি কমে যাবে, প্রবৃদ্ধি কমবে, মাথাপিছু আয় কমবে৷ কমা বলা ঠিক হবে না৷ আগে বেশি দেখানো হয়েছে৷ এখন বাস্তব চিত্র প্রকাশ পাবে৷’
ড. তিতুমীর বলেন, ‘ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর পেছনে রাজনীতি আছে৷ কথিত উন্নয়ন দেখানোর প্রবণতার কথা তো পন্ডিতরা বলেন৷ কিন্তু, প্রকৃত অবস্থা জানতে হলে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দরকার৷’