দুই বছরে আট আত্মীয় নিয়োগ, মাসে ২৮ প্যাকেট গুঁড়ো দুধ!
নিজের নিয়োগের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আটজন আত্মীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন। আর এসব নিয়োগের জন্য নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করেননি তিনি।
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক’-এর ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে এসব অভিযোগ উঠে এসেছে। পাঁচ পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি টাকায় ‘নবাবি হালে’ জীবনযাপন, আইন ভঙ্গ, উপঢৌকন গ্রহণসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।
শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূঁইয়ার অপসারণের দাবিতে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই অংশটি। গত ২২ জুন থেকে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে তালা দিয়ে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সাংবাদিকদের সামনে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন শিক্ষকরা।
তবে শ্বেতপত্রে উত্থাপিত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে শাবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এ পরিচালক।
দুই বছরে আট আত্মীয় নিয়োগ
শ্বেতপত্রে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ‘স্বজনপ্রীতি ও আইনভঙ্গ’ শিরোনামে অভিযোগ আনা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আমিনুল হক ভূঁইয়ার শ্যালক হুমায়ুন কবীরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি চাকরির নিয়মানুযায়ী শূন্যপদে আবেদনের বয়সসীমা সর্বোচ্চ ৩০ বছর থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকে পাশ কাটিয়ে ৩০ ঊর্ধ্ব বয়সী এই শ্যালককে নিয়োগ দেওয়া হয়।’
এ জন্য নিয়োগে ‘ছলচাতুরির’ আশ্রয়ের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, নিয়োগের পর আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে হুমায়ুন কবীরের জন্য গেস্ট হাউসের সুদৃশ্য লবিটি নষ্ট করে একটি অফিস স্থাপন করা দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন নেওয়া হয়নি।’
‘স্বজনপ্রীতি ও আয়া আমদানি’ শিরোনামে অভিযোগ করা হয়, ‘প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে অনৈতিকভাবে একই কায়দায় ভিসি মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া তাঁর চাচাতো ভাই মঞ্জুরুল আলমকে ভিসির দপ্তরে এমএলএসএস পদে এবং সফিকুর রহমান চঞ্চলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ওসমানী মেডিকেল কলেজের ডিন অফিসের এমএলএসএস পদে নিয়োগ দিয়েছেন। মামাতো ভাই মো. মারুফকে রেজিস্ট্রার অফিসের স্টোরকিপার পদে, ভাগ্নে সালাউদ্দিনকে মেডিকেল সেন্টারের স্টোরকিপার পদে এবং ভগ্নিপতির চাচাতো ভাই সালাউদ্দিনকে ঢাকা গেস্ট হাউসে এমএলএসএস পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মামাতো বোন সালমা খাতুনকে আয়া পদে নিয়োগের জন্য ভিসির বাংলোতে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও বাংলোতে মুন্নি ও মুনতাজ নামে দুজন আয়া এবং রব্বানী নামে এক বাবুর্চি কর্মরত। এ ছাড়া শাবিপ্রবির অধীন রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে একজন ও পার্কভিউ মেডিকেল কলেজে তিনজন নিকটাত্মীয়কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মহিলা হলে নিয়োগকৃত বিভিন্ন অবিবাহিত আয়াদের যখন তখন ওনার বাসভবনে কিছু কাজকর্মের অজুহাতে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রাধ্যক্ষদের জোর জবরদস্তি করতেন।’
মাসে ২৮ প্যাকেট গুঁড়ো দুধ
বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় প্রতি মাসে উপাচার্যের বাসায় ২৮ প্যাকেট গুঁড়ো দুধ কেনা হতো বলে শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ অপচয় করে উপাচার্য ‘নিয়মিত মিনারেল ওয়াটার ও ডাবের পানি পান করতেন’ বলে অভিযোগ করে আন্দোলনরত শিক্ষকরা দাবি করেন, ‘ভিসি মহোদয় প্রতিদিন দুটি করে এলোভেরা পানীয় পান করতেন। এ ছাড়া প্রতি মাসে ২৮টি করে গুঁড়ো দুধের প্যাকেট তাঁর বাসার জন্য বরাদ্দ রয়েছে, যার পুরো অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে নেওয়া হতো। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ৮৪ হাজার টাকার একটি ভাউচার প্রদান করা হয়েছে।’
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ উদ্দিনের সময় ভিসি মহোদয় এক ভাউচারে ৮০০ টাকা খরচ করতে পারতেন। ভিসি হিসেবে মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করেছেন।
অধ্যাপক ড. মো. সালেহ উদ্দিনের সময় উপাচার্যের অস্থায়ী অ্যাকাউন্টের (কন্টেনজেন্সি অ্যাকাউন্ট) মাধ্যমে বছরের আপ্যায়ন বাবদ এক লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া সেটি বাড়িয়ে দেড় লাখ টাকা করেছেন। এ ছাড়া প্রতি মাসে ভিসির কার্যালয় থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার আপ্যায়ন বাবদ ভাউচার করা হয়।
চাপ দিয়ে এলইডি টেলিভিশন
‘উপাচার্যের টেলিভিশন-প্রীতি ও ভোজন বিলাস’ শিরোনামে শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়, ‘সিলেটের পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ অনুমোদনের জন্য কর্তৃপক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে এলে উপাচার্য তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দুটি এলইডি টেলিভিশন দাবি করেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ দুটি এলইডি টেলিভিশন দিতে বাধ্য হয়। অনুমোদনের পর ওই প্রতিষ্ঠানে পুষ্টিবিদের পদ সৃষ্টি করে সেখানে ভিসির নিকটাত্মীয়কে নিয়োগ দিতেও উপাচার্য তাঁদের বাধ্য করেন। এ ছাড়া আল-আমিন ডেন্টাল কলেজের অনুমোদনের জন্য ১৯ জনের এক বহর নিয়ে পরিদর্শনে যান এবং পরিদর্শন শেষে রোজ ভিউ (ফাইভ স্টার) হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন। উপাচার্যের দ্বিতীয় স্ত্রীর সিলেটে প্রথম আগমন উপলক্ষে ভুয়া ভাউচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তছরুপ করে বিশাল ভোজন ও গান-বাজনার আয়োজন করেন।
পরিদর্শনের নামে আর্থিক সুবিধা
উপাচার্যের বিরুদ্ধে ‘পরিদর্শন বাণিজ্যের’ অভিযোগ করে আন্দোলনরত শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শককে না জানিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো উপাচার্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কলেজ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের মাধ্যমে কলেজগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতে নিয়মিত পরিদর্শনের বাইরেও তিনি একাধিক পরিদর্শন করেন। যখন তখন উপাচার্যের অনির্ধারিত পরিদর্শনের কারণে অধিভুক্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ অতিষ্ঠ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন ব্যাপক সম্মানহানি হয়েছে, তেমনি পরীক্ষার সময় প্রত্যেক মাসে অধিভুক্ত বাজেট থেকে ৪০-৫০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়মিত একাডেমিক কাউন্সিলের এজেন্ডায় না এনে জরুরি একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে পাস করিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে শ্বেতপত্রে।
অভিযোগ প্রত্যাখ্যান উপাচার্যের
তবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে আনা এসব অভিযোগই প্রত্যাখ্যান করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এই তথাকথিত শ্বেতপত্র দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। এখানে যা উপস্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অতিরঞ্জিত। এখানে এমন কিছু বিষয় আছে যার অনেক কিছুই উপাচার্যের এখতিয়ারভুক্ত এবং নিয়ম-নীতি মেনেই সব কিছু করা হয়েছে।’
উপাচার্য স্বজনপ্রীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার শ্যালক নিয়োগ পেয়েছে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়। তাঁকে নিয়োগ দিয়েছে শাবিপ্রবি সিন্ডিকেট। নিয়োগ কমিটিতে আমি ছিলাম না। আজ যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরাই নির্বাচক কমিটিতে ছিলেন। এ ছাড়াও এমন সব নামের উল্লেখ আছে যাদের কোনো অস্তিত্বই নেই।’
অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে শাবি উপাচার্য বলেন, ‘শ্বেতপত্রে উল্লেখিত ভোজ ও আয়োজনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অর্থ ব্যবহার করা হয়নি। আমার বিবাহবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সমস্ত খরচ আমি বহন করেছি।’ এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরো বলেন, ‘উক্ত অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকসহ সিলেটের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।’
চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া আরো বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি অফিসে যেতে পারছি না। কতিপয় শিক্ষক ওখানে বসে আছেন। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।’
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মৌন মিছিল ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে শাবি উপাচার্য বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সবাই চান বিশ্ববিদ্যালয় আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসুক।’
জাতীয় সংসদেও এ ব্যাপারে কথা হয়েছে উল্লেখ করে উপাচার্য আশা প্রকাশ করেন, অতি দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।