হলে ভোট নিলে কঠোর আন্দোলন!
আগামী ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোটের হাওয়া লেগেছে ক্যাম্পাসজুড়ে। আলোচনা চলছে ঘটা করেই। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি হবে না, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। সব ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য ডাকসু নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ ২৮ বছর পর উপহার দিতে পারবে কি না, এখন সেটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল আলোচনার বিষয়।
ক্যাম্পাসজুড়েই বইছে নির্বাচনী হাওয়া। সেই হাওয়ায় মিশে আছে নির্বাচনী শঙ্কাও। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যাতে কোনো ধরনের শঙ্কাবোধ না থাকে—বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে সেই নিশ্চয়তা আদায় করে নিতে তৎপর ছাত্রসংগঠনগুলো। বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা কোনোভাবেই চায় না বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হোক। তাদের দাবি, হলে ভোট গ্রহণ করলে সেই ভোটে অবশ্যই একটি রাজনৈতিক পক্ষ কারচুপির চেষ্টা করবে।
এ ছাড়া আরো কয়েকটি ছাত্রসংগঠন হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এরপরও যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ চুপ করে বসে থাকবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। সংগঠনটির নেতারা জানান, হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় অনড় থাকলে তারা (কোটা আন্দোলনকারী) কঠোর আন্দোলনে যাবেন।
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা ছাড়াও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তাপ চরমে। চায়ের আড্ডায় ডাকসু নির্বাচনী আবেশ বিরাজ করছে। টিএসসির মোড়ে জালালের চায়ের দোকানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের চার বন্ধু গল্পে মাতেন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। এই প্রতিবেদক তখন চায়ের দোকানেই উপস্থিত ছিলেন। পরে তাঁদের সঙ্গে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা এনটিভি অনলাইনের। তাঁদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নাজমুল হুদা নামের একজন শিক্ষার্থী বলে উঠলেন, ‘হলে ভোট গ্রহণ করা হলে অনাবাসিক ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে বলে মনে হয় না। ঝামেলা হতে পারে। ভোট কারচুপির সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। আগের রাতেও ব্যালট বাক্স ভর্তি হয়ে যেতে পারে!’
জবাবে নাজমুলের বন্ধু তরিকুল ইসলাম বললেন, ‘আচ্ছা, নির্বাচনী সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি কি একেবারেই গেল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়েও কী সব ভাবছি আমরা! তবে সত্যিই যদি এই পরিস্থিতির ভেতরে দিয়ে নির্বাচন হয়, আমি চাইব ভোট না হোক। প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসু নির্বাচনের জন্য কলঙ্কিত হবে, সেটা আমি চাই না। প্রশাসনকে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। সব ছাত্রসংগঠন অংশগ্রহণ করবে। উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হোক। তবেই হবে নির্বাচনের আসল মজা। ভোটই যদি হয় তবে সিলেকশন না হোক!’
জালালের চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে এসব ব্যাপারে কথা হয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনের সঙ্গে। নাজমুল হুদার সঙ্গে সুর মিলিয়ে হাসান আল মামুন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলে ভোট গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে কঠোর আন্দোলনে যাব। কারণ, হলে ভোট গ্রহণ করা হলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে ভয়ে ও আতঙ্কে থাকবে। হলের বাইরে থাকা অনাবাসিক ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী ভোটকেন্দ্রে যেতে অনীহাও প্রকাশ করতে পারে। শিক্ষার্থীরা একটি সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। সুতরাং আমরা যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায়ে পাশে থাকি, তারা চাই না বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হোক। বিশ্ববিদ্যালয় তো আমাদের প্রাণের ও আবেগের স্থান। তাই নির্বাচনী কমিটি হলে ভোট গ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সামনে কঠোর আন্দোলন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।’
হাসান আল মামুন আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কিন্তু গৌরব-ঐতিহ্য আছে, সেটা কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই জানে। সেই গৌরব ও ঐতিহ্যকে নষ্ট করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে না নেওয়ার জন্য অনুরোধ করব। আমরা প্রত্যাশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সবার দাবি মেনেই হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করবে। মুক্ত স্থানে ব্যবস্থা করলেও আমাদের সমস্যা নেই। আমরা চাই প্রকাশ্যেই সবকিছু হোক। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাটা ফিরে আসুক। জনপ্রিয় প্রার্থীরাই সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে ভিপিসহ অন্য পদগুলোতে নির্বাচিত হোক। আর যদি হলেই ভোট গ্রহণ করা হয়, তাহলে আমরা সেটা মেনে নেব না।’
হলে ভোট গ্রহণের বিরোধিতার কারণ জানতে চাইলে হাসান আল মামুন বলেন, ‘দেখুন, হলে কিন্তু ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ভোট গ্রহণ করা হলে ওই হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও কিন্তু ভয়ে থাকবে। যারা ঝামেলা চায় না, তাদের ভেতরে কেউ কেউ কিন্তু নানা অজুহাতে হল ত্যাগ করারও চেষ্টা করবে। হলের বাইরের শিক্ষার্থীরা তো হলে যেতেই চাইবে না। হলে শিক্ষার্থীরা তাদের সঠিক মতামত প্রদান করতে পারবে না বলে আমার মনে হয়। সুতরাং যেখানে এত সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে, সেখানে কেন্দ্র করার প্রশ্নই ওঠে না। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হবে। আশা করছি, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে।’
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে আমরা সবাই একমত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ভোট গ্রহণ করা হলে আমরা আন্দোলনে যাব। আমরা জানি, আজকে হলগুলোকে কীভাবে একটি সংগঠন তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই আমাদের সবার দাবি থাকবে, হলের বাইরেই ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা। সেটা যদি প্রশাসন করতে না পারে, তবে এখানে নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হতে দেবে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা।’
ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি জি এম জিলানী শুভ বলেন, ‘গত ২৮ বছরে বিভিন্ন ক্ষমতার পালাবদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন যদি ডাকসু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে সে নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হবে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ধরনের কোনো প্রহসনকে ছাড় দেবে না।’