ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় অবদান রাখায় চার শিক্ষাবিদকে সম্মাননা
দেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে অবদান রাখায় চার শিক্ষাবিদকে সম্মাননা দেওয়া হয়। আয়োজনে নারীদের সহায়তা সংস্থা উইংস। শিক্ষা, অগ্রগতি ও মুক্তি থিমে স্কলাসটিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুর্শেদ, বিআইটির প্রতিষ্ঠাতা লুবনা চৌধুরী, সাউথব্রিজের প্রতিষ্ঠাতা জিনাত চৌধুরী এবং সানিডেলের প্রতিষ্ঠাতা তাজিন আহমেদকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়।
বনানীর একটি রেস্টুরেন্টে শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানে চারজনকে উত্তরীয় ও রুপার ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। সম্মাননা প্রদান প্রসঙ্গে উইংসের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট টুটলি রহমান বলেন, ‘আটবছর আগে আমরা মেয়েদের জন্য একটি সাপোর্ট গ্রুপ হিসেবে উইংস প্রতিষ্ঠা করি। এখানে সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাবঞ্চিত উভয়শ্রেণির নারীর জন্যই সহায়তাও দেওয়া হয়। প্রতিবছর সংগঠন থেকে নারীদের সম্মাননা দেওয়া হয়। আজ আমরা বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় অবদান রাখা চার নারীকে সম্মাননা জানাচ্ছি। এটি সরকারিভাবে কখনোই করা হয়নি। এই স্বাধীনতার পর ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অবদান রাখার পাশাপাশি তরুণদের এগিয়ে নিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। আমাদের সন্তানদের জন্য দেশে ও বিদেশে নিজেকে উন্মোচনের পথ খুলে দিয়েছেন। তাই আজ আমরা এমন চারজনকে সম্মাননা দিচ্ছি যাদের অবদান আড়ালেই থেকে গেছে। আমাদের ইচ্ছা পরবর্তীতে আরও বড় পরিসরে এমন এইসব শিক্ষাবিদকে সম্মান জানানো।’
১৯৭৭ সালে স্কলাস্টিকা প্রতিষ্ঠা করেন ইয়াসমিন মোর্শেদ। পরবর্তীতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূতও। আজ সম্মাননা পেয়ে ইয়াসমিন মোর্শেদ বলেন, ‘আয়োজকদের ধন্যবাদ আমাদের এভাবে ধন্যবাদ জানানো। আমরা কলোনিয়াল সিস্টেমের পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম যা অত্যন্ত চমৎকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার পর চরম জাতীয়তাবাদ প্র্যাকটিসের কারণে ইংরেজি মিডিয়াম বন্ধ করে বাংলা মিডিয়াম পড়তে বাধ্য করা হয়।’
শুধু বাংলায় পড়াশোনা করার জন্য জোর করা হয়। যাদের সামর্থ্য ছিল তারা বিদেশে পাঠাতে পেরেছিলেন কিন্তু দেশের ভেতরে বাংলা পড়তে বাধ্য করা হয়। সে সময় যারা ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বাংলা মিডিয়ামে আসতে বাধ্য হয় তারা সমস্যায় পড়ে যায়। সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার পর আমরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রয়োজন অনুভব করি এবং তারই ধারবাহিকতায় স্কলাস্টিকা গড়ে তোলা হয়।
ইয়াসমিন মোর্শেদ বলেন, ‘বাংলা মিডিয়ামে পড়া কর্মকর্তারা এমন আচরণ করে যেন আমরা ইংরেজি মাধ্যম চালিয়ে কোনো অপরাধ করছি। আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের বাচ্চারা ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাও শিখছে। তারপরও আমরা রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়াই আমরা নিজেদের চেষ্টায় শুরু করেছি ও দাঁড়িয়েছি। দেশ আমাদের স্বীকৃতি না দিলেও আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছি। পয়তাল্লিশ বছর পর আজ এই সম্মাননা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। অবশেষে আমাদের জীবনের এত বছর আর এত চেষ্টার স্বীকৃতি পেলাম। আমার ৭৮ বছরের জীবনে এই প্রথম ধন্যবাদ পেলাম।’
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়ালের প্রতিষ্ঠাতা লুবনা চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশে ইংরেজি মাধ্যম ব্যান ছিল। রাষ্ট্রদূত বা অন্যান্য বিদেশিদের বাচ্চাদের গ্রিন হ্যারল্ডে পড়াত। আর বাংলাদেশি বাচ্চাদের তো বিদেশেই পাঠিয়ে দিতো যাদের সুযোগ ও সামর্থ্য ছিল। স্কুলের অনুমতি না থাকলেও টিউটোরিয়াল করার অনুমতি ছিল। এ সব টিটোরিয়ালে প্রতি ক্লাসে মাত্র ১৫ জন ছাত্র ভর্তি করা যেত। তাই স্কুল নাম না দিয়ে টিউটোরিয়াল নাম দেই। সেই টিউটোরিয়াল নাম আর পরে বদলানো হয়নি। ধীরে ধীরে আমরা আমরা নিজেদের চেষ্টায় স্কুলভবন বানাই। এই চলার পথে সরকার থেকে কোনো সাহায্য করেনি। বর্তমানে এটিকে ট্রাস্টে পরিণত করা হবে।’
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সাউথব্রিজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল জীনাত চৌধুরী বলেন, ‘একটি মুভি দেখেছিলাম অ্যাক্সিডেন্টাল ট্যুরিস্ট নামে। আমার জীবনের গল্প অনেকটা সেরকম। আমি অ্যাক্সিডেন্টালি প্রিন্সিপাল হয়ে যাই। ইউকে থেকে দেশে ফিরে গ্রিন হেরাল্ডে চাকরি শুরু করি। তারপর সিস্টার ইমেলডার সাহায্য ও তত্ত্বাবধানে ধানমন্ডিতে সাউথব্রিজ প্রতিষ্ঠা করি। সিস্টার ইমেলডাই ঠিক করে দেন কোন রুমে কোন ক্লাস বসবে। তিনি আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন যে আমি পারব। তাই বলা যায়, আমি অ্যাক্সেডেন্টালি প্রিন্সিপাল হয়ে গেছি। অ্যাক্সিডেন্ট করলে মানুষ নানা কিছু হারায় কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আমি কিছু হারায়নি বরং অনেক কিছু অর্জন করেছি।’
সানিডেলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল তাজিন আহমেদ বলেন, ‘১৯৮৪ সালে বাংলা মিডিয়াম হিসেবে চালু হলেও ১৯৮৫ সালে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে রূপান্তর হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমরা বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি চলেছি। সানিডেল ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান ও কারিকুলাম অনুসরণ করলেও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা দেশে ও বিদেশে সমানতালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে এবং নিজ নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাসহ নানা প্রতিযোগিতায় তারা অংশ নেয়। সানিডেলের সাফল্য শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের সামগ্রিক অগ্রগতির একটি অংশ। দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের সম্মাননা জানানোর এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। সেইসঙ্গে টুটলি রহমানকে ধন্যবাদ এই আয়োজনের জন্য।’