একজন কালামের গল্প
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/07/29/photo-1438160321.jpg)
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ জন্ম নেন, যাঁরা যুগ যুগ ধরে নিজগুণে সমাদৃত হন মানুষের কাছে। এমনই একজন মানুষ ছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম।
১৯১৩ সালে তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম উপকূলীয় এলাকায় এক দরিদ্র জেলে পরিবারে জয়নুল আবদিনের ঘরে আবুল পাকির জয়নুল আবদিন আবদুল কালাম নামের ছেলেটির জন্ম। সাত ভাইবোনের অভাবী সংসারের বোঝা টানতে তাঁকেও অল্প বয়সে নামতে হয় কাজে। ভীষণ মেধাবী ও কঠোর পরিশ্রমী এই বালক সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নানা কাজে ব্যস্ত রাখত নিজেকে। অভাবের তাড়নায় খুব ভালো সুবিধা সে কখনই পায়নি; কিন্তু পড়াশোনার প্রতি গভীর আগ্রহ তাঁকে পিছিয়ে পড়তে দেয়নি। স্নেহশীল মা আশ্বিমা অভাব সত্ত্বেও মেধাবী পুত্রের জন্য জমিয়ে রাখতেন কুপির কেরোসিন, যা জ্বালিয়ে প্রতিভাবান এই ছেলেটি অব্যাহত রাখত তাঁর পড়াশোনা। এভাবে নিজ প্রচেষ্টায় তিনি প্রথমে ইউনিভার্সিটি অব মাদ্রাজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ও পরে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ১৯৬০ সালে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম হন। বিজ্ঞান গবেষণায় তিনি প্রচুর আগ্রহী ছিলেন। দীর্ঘ চার বছর তিনি কাজ করেছিলেন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রশাসক হিসেবে। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সঙ্গেও ছিল তাঁর সম্পৃক্ততা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মিসাইলের ওপর গবেষণা করেছেন। ব্যালাস্টিক মিসাইল ও তার উৎক্ষেপণ যান তৈরিতে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি অর্জন করেন ভারত সরকারের বিপুল সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’, ‘ভারতরত্ন’ উপাধি। ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
তিনি ছিলেন জনদরদি একজন রাষ্ট্রপতি। নিজে কষ্টে বড় হয়েছিলেন বলেই হয়তো দেশের গরিব জনগণের প্রতি তাঁর বিশেষ নজর ছিল। তিনি ভারতের দারিদ্র্য দূরীকরণে ছিলেন সচেষ্ট। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তিনি ভারত কর্মসংস্থান আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন নগর ও গ্রামে অর্থনৈতিক ব্যবধান ঘোচানোর চেষ্টা করেছিলেন। ব্যাপক সহায়তা করেছিলেন ভারতের বেসামরিক স্থাপনা, বাঁধ, ইস্পাতশিল্প, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য।
প্রজ্ঞা ও জ্ঞানে তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি মানতেন, ‘স্বপ্ন সত্যি করার আগে স্বপ্ন দেখতে হবে।’ জীবনে তিনি অনেক ঠেকেছেন এবং শিখেছেন। অনেক কষ্ট করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়েছেন; কিন্তু কখনই পিছিয়ে পড়েননি। সাহস ও অসাধারণ কর্মক্ষমতা তাঁকে সব বাধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। তাঁর মতে, ‘বৃষ্টির সময় প্রত্যেকটি পাখি কোথাও না কোথাও আশ্রয় নেয়। কিন্তু ঈগল মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে বৃষ্টিকে এড়িয়ে যায়।’ সত্যিই তিনি ছিলেন ঈগলের মতো দূরদর্শী। তিনি জানতেন শ্রমের মূল্য, মানুষের মূল্য কীভাবে দিতে হয়। অন্যকে সাহায্য করতে তিনি ভালোবাসতেন; কাউকে হারাতে নয়, বরং প্রতিপক্ষের মন জয় করাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা এই মানুষটি ব্যর্থতাকে মেনে নিতে শিখেছিলেন সফলতার সিঁড়ি হিসেবে। তিনি বলতেন, ‘সফলতার গল্পে একটি বার্তা থাকে। কিন্তু ব্যর্থতার গল্পে সফল হওয়ার উপায় থাকে।’ দল-মত নির্বিশেষে তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন ও ভালোবাসার পাত্র। নিঃস্বার্থ ও জনদরদি এই মানুষটি বিয়ে করেননি। খুব সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন সব সময়। প্রেরণামূলক ও শিক্ষাবিষয়ক বক্তৃতা দিতে তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে তরুণদের প্রেরণা জুগিয়েছেন।
গত ২৭ জুলাই অসাধারণ এই ব্যক্তির মৃত্যুতে ভারতজুড়ে নামে শোকের ছায়া। ভারত সরকার ঘোষণা করে সাত দিনের শোক। শ্রদ্ধা জানায় ভারতের সর্বস্তরের জনগণ। তাঁর জীবন থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।