মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদিরাম বসু
কিশোর ক্ষুদিরাম বসু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন ব্রিটিশদের হাত থেকে নিজের জন্মভূমি ভারতকে মুক্ত করতে, মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার পতাকা উড়াতে। এ জন্য ফাঁসির দঁড়িকেও তিনি করেছেন তুচ্ছ জ্ঞান, হাসতে হাসতে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন মৃত্যুকে।
আজ থেকে ১০৭ বছর আগের এমনই একটা দিনে ফাঁসির মঞ্চে আত্মদান করতে হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুকে। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট, সময় তখন ভোর ৫টা। ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। যারা ফাঁসিতে ঝুলাবেন তাঁরাও প্রস্তুত।লোহার গরাদ দেওয়া গেটটি তখনো বন্ধ। হঠ্যাৎ গেটটি খুলে গেল। সেই গেট পেরিয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছেন একটি কিশোর, তিনি আর কেউ নন, ক্ষুদিরাম।
চারপাশে পুলিশ প্রহরায় কিশোর ক্ষুদিরাম এগিয়ে চলেছেন গেট থেকে একটু দূরেই ১৫ ফুট উঁচুতে তৈরি করা ফাঁসির মঞ্চের দিকে। দুই দিকে দুইটি খুঁটি আর একটি লোহার রড আড় দ্বারা যুক্ত, মাঝখানে বাঁধা মোটা এক গাছা দঁড়ি। এখানেই ঝুলানো হবে ক্ষুদিরামকে। শেষ হাসি দিয়ে মঞ্চে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ক্ষুদিরাম। জল্লাদ মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়ে। এখন অপেক্ষা কেবল মৃত্যুর। উপস্থিত এক প্রহরীর হাত ততক্ষণে বসে আছে কোনায় স্থাপন করা হ্যান্ডেলের ওপর।
উডমেন সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উড়িয়ে দিলেন তার হাতে থাকা সাদা রঙের একটি রুমাল। নিমেষের মধ্যে ক্ষুদিরাম হারিয়ে গেলেন কোনো এক অতল গহ্বরে। তাহলে উডমেনের হাতের ওই রুমালের মধ্যেই কি ছিল ক্ষুদিরামের ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিনের বৈপ্লবিক জীবন?
মেধাবী এই দেশপ্রেমিক অন্যায়কে মেনে নিতে পারেননি কখনো। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় লেখা পড়াতেও বেশি দূর এগোতে পারেননি বোনের কাছে বড় হওয়া ক্ষুদিরাম। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় এই কিশোর ১৯০৩ সালে অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালীন বাদ দেন পড়াশোনা। তখন থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর দুঃসাহসিকতা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে তাঁর কণ্ঠ।
১৯০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী নেতা শ্রী অরবিন্দ এবং সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করে জনসম্মুখে বক্তব্য দেন এবং বিপ্লবী দলগুলোর সাথে গোপন পরিকল্পনা করেন। তখন তরুণ ছাত্র ক্ষুদিরাম বিপ্লবে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত হন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্ষুদিরাম তাঁর বোন অপরূপার স্বামী অমৃতার সাথে তামলুক শহর থেকে মেদিনীপুরে চলে যান। সেখানে বিপ্লবীদের একটি নবগঠিত আখড়ায় যোগ দেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষুদিরাম তাঁর গুণাবলীর জন্য সবার চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন।
ভগদেব গীতা পড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে অনুপ্রাণিত হন ক্ষুদিরাম বসু এবং যোগ দেন বিপ্লবী রাজনৈতিক দল ‘যুগান্তর’- এ। দেশের স্বাধীনতার দাবি তাঁকে নাড়া দিত খুব। এ জন্য তিনি যোগ দেন বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনে।
ক্ষুদিরাম সত্যেন বসুর নেতৃত্বে শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করেন। অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন তিনি। গুপ্ত সংগঠনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কাপড় জ্বালিয়ে দেন এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত লবণ বোঝাই নৌকা ডুবিয়ে দেন। এসব কর্মকাণ্ডে তাঁর সততা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সংগঠনের ভেতরে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
ওই সময়টাতে বিভিন্ন সফল বৈপ্লবিক কাজের জন্য ক্ষুদিরাম ইংরেজদের রোষানলে পরিণত হন। যেভাবেই হোক তাঁকে সাজা দেওয়ার চিন্তা করেন কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড। ক্ষুদিরামদের গুপ্ত দলের আরো বেশ কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন কিংসফোর্ড।
তাই সংগঠনের পক্ষ থেকে কিংসফোর্ডকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব পড়ে ক্ষুদিরামের ওপর। কিংসফোর্ডকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম মুজাফফরপুর গমন করেন। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম কিংসফোর্ডকে লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারেন। কিন্তু ভুলবশত বোমাটি ভুল গাড়ির ওপর গিয়ে পড়ে। এতে কিংসফোর্ড বেঁচে যান, পরের দিন সকালে ক্ষুদিরাম ওয়াইসি রেলস্টেশনে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন।
ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারা মোতাবেক ক্ষুদিরামের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। মৃত্যুর শেষ সময় পর্যন্ত ক্ষুদিরামের মনোবল ছিল দৃঢ়। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে, ক্ষুদিরাম এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করেই বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’
উপস্থিত কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন বিস্মিত হয়েছিল ক্ষুদিরামের মানসিক দৃঢ়তা আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ উপলব্ধি করে। মৃত্যুবার্ষিকীতে এই নির্ভীক দেশপ্রেমিকের জন্য রইল বুকভরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাঁর এই অসীম সাহসিকতা চিরদিনই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।