আমি মালালা বলছি
গুল মাকাইয়ের দিনলিপি
এই অন্ধকার দিনগুলোর কোনো একটাতেই বাবা বিবিসির পেশাওয়ারভিত্তিক রেডিও সংবাদদাতা, তাঁর বন্ধু আবদুল হাই কাকারের কাছ থেকে ফোনকল পেলেন। তিনি তালেবানের অধীনে জীবন সম্পর্কে দিনলিপি লেখার জন্য কোনো মহিলা শিক্ষিকা বা স্কুলছাত্রীকে খুঁজছিলেন। তিনি সোয়াতের বিপর্যয়ের মানবিক দিকটা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। শুরুতে ম্যাডাম মারিয়ামের ছোট বোন আয়েশা রাজি হলো, কিন্তু তার বাবা জানতে পারলেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ বলে অনুমতি দিলেন না।
বাবার আলোচনা শুনতে পেয়ে আমি বললাম, ‘আমি কি পারি না?’ আমি এখানকার ঘটনা সম্পর্কে মানুষকে জানাতে চাইতাম। আমি বলতাম, শিক্ষা আমাদের অধিকার। যেমনটা গান গাওয়া আমাদের অধিকার। ইসলাম আমাদের এই অধিকার দিয়েছে এবং বলেছে প্রতিটা ছেলেমেয়েকে স্কুলে যেতে হবে। কোরআনে বলা হয়েছে, আমাদের জ্ঞান অন্বেষণ করা উচিত, মনোযোগ দিয়ে গবেষণা করে পৃথিবীর রহস্যগুলো জানা উচিত।
আমি আগে কখনো ডায়েরি লিখিনি এবং কীভাবে শুরু করতে হবে, তা জানতাম না। কম্পিউটার থাকলেও প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যেত এবং সব জায়গায় ইন্টারনেট দিয়ে ঢোকাও যেত না। তাই হাই কাকার সন্ধ্যার সময় মায়ের মোবাইলে আমাকে ফোন করতেন। আমাদের রক্ষা করতে তিনি তাঁর স্ত্রীর ফোন ব্যবহার করতেন, কারণ তাঁর নিজের ফোনে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলো আড়ি পাতছে। তিনি আমাকে নির্দেশনা দিতেন, আমার দিন সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন, ছোট ছোট মজার কাহিনী বা আমার স্বপ্ন সম্পর্কে বলতে বলতেন। আমরা আধঘণ্টা বা পঁয়তাল্লিশ মিনিট উর্দুতে কথা বলতাম। আমরা দুজনেই পশতুন হওয়া সত্ত্বেও ব্লগটি উর্দুতে হবে বলেই কণ্ঠটা তিনি একেবারে অকৃত্রিম করতে চেয়েছিলেন। এর পর তিনি আমার কথাগুলো লিখে রাখতেন এবং সপ্তাহে একদিন সেগুলো বিবিসির উর্দু ওয়েবসাইটে ছাপা হতো। তিনি আমাকে ১৩ বছর বয়সী অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের কথা বলেছিলেন, যে তার পরিবারকে নিয়ে নাৎসিদের থেকে আমস্টারডামে লুকিয়ে ছিল যুদ্ধের সময়। সে ডায়েরিতে তাদের গাদাগাদি করে থাকা জীবন, কাটানো দিন এবং তার নিজস্ব অনুভূতি সম্পর্কে লিখেছিল। এটা খুব কষ্টের ছিল, কারণ শেষে তার পরিবার প্রতারিত হয় এবং গ্রেপ্তার হয় আর অ্যানা ১৫ বছর বয়সে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মারা যায়। পরে তার ডায়েরি প্রকাশিত হয় এবং খুব শক্তিশালী দলিলে পরিণত হয়।
হাই কাকার বললেন যে আমার আসল নাম ব্যবহার করাটা বিপজ্জনক হতে পারে এবং তিনি আমার ছদ্মনাম রাখলেন গুল মাকাই, যার অর্থ ‘শস্যফুল’ এবং এটি একটি পশতুন লোকগল্পের নায়িকার নাম। এটা ‘রোমিও ও জুলিয়েট’ ধরনের কাহিনী, যেখানে গুল মাকাই ও মুসা খানের স্কুলে দেখা হয় এবং তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে। কিন্তু শেকসপিয়রের নাটকের মতো তাদের কাহিনী বিয়োগান্তক হয় না। গুল মাকাই কোরআন ব্যবহার করে বড়দের যুদ্ধের খারাপ দিক সম্পর্কে বোঝায়, তারা ক্রমে যুদ্ধ থামিয়ে প্রেমিকযুগলের মিলনের অনুমতি দেয়।
‘আমি ভীত’ এই শিরোনামে ২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি আমার প্রথম ডায়েরি এন্ট্রি প্রকাশিত হয়, গত রাতে আমি সামরিক হেলিকপ্টার এবং তালেবানে ভর্তি একটা স্বপ্ন দেখেছি। সোয়াতে সাময়িক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি এমন স্বপ্ন দেখছি।’ আমি তালেবানের অধ্যাদেশের কারণে এবং তারা সারাক্ষণ আমার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে থাকার কারণে আমার স্কুলে যেতে ভয় পাওয়ার কথাও লিখলাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা লিখলাম : “আমার পেছনে একটি লোককে বলতে শুনলাম, ‘আমি তোকে খুন করব।’ আমি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কিছুক্ষণ পর পেছন ফিরে দেখলাম সে আমাকে অনুসরণ করছে কি না। সে আসলে অন্য কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।”
ওয়েবসাইটে নিজের লেখা দেখাটা খুবই রোমাঞ্চকর। শুরুতে আমার কিছুটা সংকোচ ছিল, কিন্তু কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারলাম হাই কাকার কী ধরনের কথা শুনতে চান; আমি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলাম। তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতি পছন্দ করতেন। তাঁর ভাষ্যমতে আমার ‘তীব্র বাক্য’ পছন্দ করতেন, তালেবানের আতঙ্কে বিহ্বল অবস্থায় পারিবারিক জীবনের বর্ণনাও পছন্দ করতেন।
আমি স্কুল সম্পর্কে অনেক কিছুই লিখলাম, কারণ সেটা আমাদের জীবনের কেন্দ্রে অবস্থিত। আমি আমার দেখাতে নিয়ে এলো।
‘খুব ভালো’, বাবা তাঁর চিরপরিচিত হাসি দিয়ে বললেন। আমি মানুষকে বলতে চাইছিলাম যে আমিই সে, কিন্তু বিবিসি সংবাদদাতা আমাকে এটা করতে নিষেধ করেছিলেন, কারণ এটা বিপজ্জনক। আমি কারণটা বুঝিনি, কারণ আমি একটা বাচ্চা মেয়ে আর কে-ই বা বাচ্চাকে আক্রমণ করবে? কিন্তু আমার কোনো কোনো বন্ধু ঘটনাগুলোর কোনো কোনোটা চিনতে পারল। একটা এন্ট্রিতে আমি প্রায় নিজের পরিচয় দিয়েই ফেলেছিলাম : ‘মা আমার ছদ্মনাম গুল মাকাই পছন্দই করেছেন এবং বাবার সঙ্গে রসিকতা করে বলেছেন আমার নাম পাল্টে ফেলা উচিত’, আমারও এই নামটা পছন্দ, কারণ আমার আসল নামের অর্থ ‘দুঃখ-ভারাক্রান্ত’।
গুল মাকাইয়ের ডায়েরি আরো বিস্তৃত মনোযোগ আকর্ষণ করল। কোনো কোনো খবরের কাগজ চুম্বক অংশ প্রকাশ করল। বিবিসিও আরেকটা মেয়ের কণ্ঠে এর রেকর্ড তৈরি করল, আমিও দেখলাম যে কলম এবং তার থেকে উদ্ভূত শব্দ কীভাবে মেশিনগান, ট্যাংক বা হেলিকপ্টারের চাইতে শক্তিশালী হতে পারে। আমরা লড়াই করতে শিখছি। রুখে দাঁড়ালে আমরা কত শক্তিশালী এটাও শিখছি।
আমাদের কোনো কোনো শিক্ষক স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলেন। একজন বললেন যে মোল্লা ফজলুল্লাহ ইমাম দেরিতে তার সেন্টার নির্মাণের জন্য তাঁকে সাহায্য করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আরেকজন বললেন, তিনি পথে একটি মস্তকবিহীন লাশ দেখেছেন এবং শিক্ষক তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পারবেন না। অনেক মানুষ ভয় পেয়েছিল। আমাদের প্রতিবেশীরা বলল যে কারো মেয়ে অবিবাহিত থাকলে তা মসজিদে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে তালেবান, যাতে তাদের বিয়ে দেওয়া যায়। সম্ভবত জঙ্গিদের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া হবে।
যেখানে একসময় আমাদের ক্লাসে ২৭ জন মেয়ে ছিল, ২০০৯ সালের জানুয়ারির শুরুতে সেখানে ছাত্রীসংখ্যা হলো মাত্র ১০ জন। আমার অনেক বন্ধু এই উপত্যকা ছেড়ে পেশোয়ারে পড়তে চলে গেছে, কিন্তু আমার বাবা জিদ ধরে রইলেন যে তিনি সোয়াত ছাড়বেন না। ‘সোয়াত আমাদের অনেক দিয়েছে। এই কঠিন দিনগুলোতে আমাদের এই উপত্যকার জন্য দৃঢ় থাকা উচিত, তিনি বললেন।
এক রাতে আমার বাবার বন্ধু একটি হাসপাতালের মালিক ড. আফজালের বাসায় নৈশভোজে গেলাম। খাবারের পর ডাক্তার যখন আমাদের গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছিলেন, তখন আমরা রাস্তার দুপাশে বন্দুকধারী মুখোশাবৃত তালেবানকে দেখলাম। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ড. আফজালের হাসপাতালটি তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অবস্থিত। ক্রমাগত গুলির শব্দ এবং কারফিউতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি সেটা ব্যারিকটে স্থানান্তর করেছিলেন। প্রকাশ্য প্রতিবাদ হলে তালেবান মুখপাত্র মুসলিম খান তাঁকে ডেকে হাসপাতাল খুলতে বলেন। ডাক্তার বাবার পরামর্শ চাইলেন বাবা বলেন, ‘খারাপ লোকের কাছ থেকে ভালো জিনিস গ্রহণ করো না।’ তালেবান দ্বারা রক্ষিত হাসপাতাল খুব ভালো কিছু না হওয়ায় বাবা রাজি হলেন না।
ড. আফজাল আমাদের থেকে বেশি দূরে থাকতেন না, তাই আমরা নিরাপদে বাসায় পৌঁছানোর পর আমার বাবা তাঁর সাথে ফিরে যেতে চাইলেন, যদি তালেবান তাঁকে টার্গেট করে। ফেরার পথে ড. আফজাল বিব্রতভাবে বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা আমাদের থামালে আমরা কী নাম বলব?’
‘তুমি ড. আফজাল আর আমি জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই,’ বাবা উত্তর দিলেন, ‘এরা বদমাশ লোক। আমরা কোনো খারাপ কাজ করিনি। আমরা কেন নাম পাল্টাব, সেটা তো অপরাধীরা করবে।
সৌভাগ্যবশত তালেবান চলে গিয়েছিল। বাবা ফোন করে তাঁদের নিরাপদে পৌঁছানোর কথা বললে আমরা সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আমিও হাল ছাড়তে চাইনি। কিন্তু তালেবানের সময়সীমা নিকটবর্তী হচ্ছিল—মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে কীভাবে তারা ৫০ হাজার মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করবে? আমি আশায় আশায় থাকলাম যে কিছু একটা হবে এবং স্কুলগুলো খোলাই থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডেডলাইন চলে এলো। আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলাম যে খুশাল স্কুলের ঘণ্টাই সবার বাজা বন্ধ করবে। ম্যাডাম মারিয়াম, এমনকি সোয়াতে থাকার জন্য বিয়ে পর্যন্ত করেছেন। তাঁর পরিবার ঝামেলা এড়াতে করাচিতে চলে গেছে এবং মহিলা হিসেবে তিনি তো একা থাকতে পারেন না।
জানুয়ারির ১৪ তারিখ বুধবারে আমার স্কুল বন্ধ হলো, আর সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আমার শোবার ঘরে টিভি ক্যামেরা দেখতে পেলাম। ইরফান আশরাফ নামের এক পাকিস্তানি সাংবাদিক আমাকে দাঁত ব্রাশ এবং নামাজ পড়ার সময়ও অনুসরণ করছিলেন।
আমি বলতে পারি আমার বাবার মেজাজ খারাপ ছিল। তাঁর এক বন্ধু তাঁকে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্রে অংশগ্রহণ করতে রাজি করিয়েছেন, এতে পৃথিবীর মানুষকে আমাদের অবস্থা দেখানো হবে। কয়েক সপ্তাহ আগে আমরা পেশোয়ারে মার্কিন সাংবাদিক অ্যাডাম এলিকের দেখা পেয়েছিলাম। সেটা একটা আজব সভা ছিল, কারণ সে বাবার সাথে ইংরেজিতে বিশাল এক সাক্ষাৎকার চালিয়ে গেল; কিন্তু আমি একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি। এরপর তিনি ইরফানকে দোভাষী হিসেবে ব্যবহার করে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুমতি চাইলেন। প্রায় ১০ মিনিট পর তিনি আমার মুখের ভাব দেখে বুঝলেন, আমি তাঁর প্রতিটি কথা বুঝতে পারছি। ‘তুমি ইংরেজি বলতে পারো?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ, আমি এই মাত্র বলছিলাম যে আমার মনে একটা ভয় আছে।’ আমি উত্তর দিলাম। অ্যাডাম অবাক হয়ে গেল। ‘তোমাদের সমস্যা কী?’ তা আমার বাবাকে এবং ইরফানকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘সে তোমাদের দুজনের চেয়ে ভালো ইংরেজি বলে আর তোমরা তাকে অনুবাদ করে দিচ্ছ!’ আমরা সবাই হাসলাম।
প্রামাণ্যচিত্রের আসল পরিকল্পনা ছিল স্কুলের শেষ দিন আমার বাবাকে অনুসরণ করা, কিন্তু সভার শেষে ইরফান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি এমন দিন আসে যে তুমি তোমার উপত্যকা এবং স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না?’ আমি বললাম যে এটা ঘটবে না। সে জোর করতে থাকলে আমি ফোঁপাতে শুরু করলাম। আমার মনে হয়, অ্যাডাম তখনই আমার ওপর ফোকাস করার সিদ্ধান্ত নেয়।
অ্যাডাম সোয়াতে আসতে পারেনি, কারণ জায়গাটা বিদেশিদের জন্য খুবই অনিরাপদ। ইরফান এবং একজন ক্যামেরাম্যান মিঙ্গোরায় এলে আমাদের বাসায় থাকা আমার এক কাকা বারবার বলতে লাগলেন যে আমাদের বাসায় ক্যামেরা থাকা খুবই বিপজ্জনক। বাবাও তাদের ক্যামেরাগুলো লুকাতে বললেন। কিন্তু তারা অনেক দূর থেকে এসেছিল এবং আমাদের পশতুনদের পক্ষে আতিথেয়তার অস্বীকৃতি জানানো খুবই কঠিন, তা ছাড়া বাবা জানতেন যে এটা আমাদের জন্য বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মেগাফোন হিসেবে কাজ করতে পারে। তাঁর বন্ধু তাঁকে বলেছিল যে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর চাইতে এটাই বেশি প্রভাব বিস্তার করবে।
আমি অনেক টিভি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম এবং মাইক্রোফোনে কথা বলতে এত মজা পেতাম যে আমার বন্ধুরা আমাকে ক্ষেপাত। কিন্তু এটার মতো কিছু আমি কখনো করিনি। ‘স্বাভাবিক থাকো,’ ইরফান বলল। আমার চারদিকে ঘুরে বেড়ানো ক্যামেরা নিয়ে সেটা মোটেও সহজ ছিল না, দাঁত ব্রাশ করার সময়ও ক্যামেরা ছিল। আমি আমার পরতে না পারা ইউনিফর্ম তাদের দেখালাম এবং বললাম যে তালেবান আমাকে স্কুলে যেতে দেখলে আমার মুখে এসিড মারবে। বলে ভয় পাচ্ছিলাম, যেমনটা তারা আফগান মেয়েদের করেছিল।
সেই চূড়ান্ত সকালে আমরা বিশেষ অ্যাসেম্বলি করলাম, কিন্তু চক্কর দিতে থাকা হেলিকপ্টারের শব্দে কথা শোনাই দায়। কেউ কেউ উপত্যকায় যা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল। শেষবারের মতো ঘণ্টা বাজল এবং ম্যাডাম মরিয়াম শীতের ছুটি শুরু হচ্ছে বলে ঘোষণা করলেন। কিন্তু এবারে অন্যান্য বছরের মতো পরবর্তী পর্ব শুরুর তারিখ ঘোষণা করা হলো না। তবুও কোনো কোনো শিক্ষক আমাদের বাড়ির কাজ দিলেন। স্কুলের উঠানে আমি আমার বন্ধুদের জড়িয়ে ধরলাম। অনার্স বোর্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, আমার নাম আর কখনো সেখানে উঠবে কি না। মার্চ মাসে পরীক্ষা হওয়ার কথা, কিন্তু কীভাবে হবে? একেবারেই পড়াশোনা না করে প্রথম স্থান অর্জন করার কোনো অর্থ নেই। কেউ কলম ছিনিয়ে নিয়ে গেলেই বোঝা যায় শিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ।
স্কুলের দরজা বন্ধ করার আগে আমি পেছনে তাকিয়ে দেখে নিলাম, যেন এটাই স্কুলের শেষ দিন। প্রামাণ্যচিত্রের একটি অংশের সমাপনী দৃশ্য এটি। বাস্তবে আমি আবার ভেতরে ফিরে গেলাম। আমি আর আমার বন্ধুরা চাইনি যে ওই দিনটি শেষ হয়ে যাক, তাই আমরা আরো কিছুক্ষণ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রাইমারি স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করার অনেক জায়গা ছিল, আমরা সেখানে চোর-পুলিশ খেললাম। এরপর আমরা ম্যাঙ্গো ম্যাঙ্গো খেললাম, সেখানে একটা বৃত্ত বানিয়ে গান গাইতে হয়, আর গান থেকে গেলে সবাইকে থেমে যেতে হয়। যে হাসবে না নড়বে সে বাদ।
সেদিন আমরা দেরিতে বাড়ি ফিরলাম। সাধারণত আমরা দুপুর ১টায় বাসায় যাই, কিন্তু সেদিন ৩টা পর্যন্ত থাকলাম। যাওয়ার আগে আমি আর মনিবা খুব তুচ্ছ একটা বিষয়ে কথাকাটাকাটি করলাম। এতই তুচ্ছ যে আমার এখন মনেই নেই। আমাদের বন্ধুরা এটা বিশ্বাস করতে পারল না। ‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ থাকলেই তোরা দুজন শুধু ঝগড়া করিস।’ তারা বলল। এটা মোটেও কোনো কিছু ছেড়ে যাওয়ার ভালো উপায় ছিল না।
আমি প্রামাণ্যচিত্র তৈরিকারকদের বললাম, ‘তারা আমাকে থামাতে পারবে না। বাড়িতে হোক, স্কুলে হোক আর যেখানেই হোক, আমি শিক্ষা গ্রহণ করবই। পৃথিবীর কাছে এটা আমাদের অনুরোধ আমাদের স্কুল রক্ষা করুন, আমাদের পাকিস্তান রক্ষা করুন, আমাদের সোয়াত রক্ষা করুন।’
বাসায় ফিরে আমি কাঁদতেই থাকলাম। আমি শেখা বন্ধ করতে চাইনি। আমার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর, কিন্তু আমার মনে হলো আমি সব হারিয়েছি। আমি ক্লাসের সবাইকে বলেছিলাম, তালেবান এটা করতে পারবে না। ‘তারা ঠিক আমাদের রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলে, কিন্তু আজ করে না।’ আমি বলতাম। কিন্তু তারা আমাদের স্কুল বন্ধ করে দিল এবং আমি বিব্রতবোধ করলাম। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আমি কাঁদছিলাম, মা কাঁদছিলেন কিন্তু বাবা জোর দিয়ে বললেন, ‘তুমি স্কুলে যাবে।’
বাজার জন্য স্কুল বন্ধ হওয়ার অর্থ ব্যবসাও বন্ধ হওয়া। শীতের ছুটির পর ছেলেদের স্কুল খুললেও মেয়েদের স্কুল বন্ধ হওয়াটা আমাদের আয়ে বিরাট ঘাটতি নিয়ে এলো। স্কুল ফির অর্ধেকেরও বেশি বাকি ছিল এবং বাবা শেষ দিনটা ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন এবং বিদ্যুৎ-পানির বিলের জন্য অর্থ জোগাড় করতেই কাটালেন।
সেই রাতে বাতাস কামানের শব্দে ভরপুর ছিল, আমি তিনবার ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিলাম। পরদিন কালে সবকিছুই বদলে গিয়েছিল। আমি ভাবতে লাগলাম আমার পেশোয়ারে বা বিদেশে যাওয়া উচিত অথবা তালেবান শাসনামলে আফগানরা যেমনটা করেছিল, তেমনভাবে আমাদের বাসায় একটা গোপন স্কুল চালাতে আমাদের শিক্ষকদের অনুরোধ করব। পরে আমি যথাসম্ভব রেডিও এবং টিভি চ্যানেলে গেলাম। ‘তারা আমাদের স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে, কিন্তু শিক্ষা থেকে বিরত রাখতে পারবেন না’, আমি বললাম। আমার কণ্ঠ আশাবাদী শোনাচ্ছিল, কিন্তু মনে মনে আমি চিন্তিত ছিলাম। আমি আর বাবা পোশাওয়ারে নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে আমাদের অবস্থা সবাইকে বলতে থাকলাম। মহিলাদের জন্য মহিলা শিক্ষক এবং ডাক্তার চাওয়ার পরও এসব চাকরির জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে মেয়েদের স্কুলে যেতে না দেওয়ায় তালেবান যে হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাও আমি বললাম।
একবার মুসলিম খান বলেছিল, মেয়েদের স্কুলে গিয়ে পশ্চিমা কায়দা শেখা উচিত না। এটা এমন এক লোকের কথা যে অনেক দিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছে। সে জিদ ধরল যে সে তার নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা চালু করবে। ‘মুসলিম খান স্টেথোস্কোপ এবং থার্মোমিটারের বদলে কী ব্যবহার করবে?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন। ‘অসুস্থদের চিকিৎসা করার কোনো পূর্বদেশীয় যন্ত্র কি আছে?’ তালেবান শিক্ষার বিপক্ষে কারণ তারা ভাবে যে কোনো বাচ্চা একটা বই পড়লে বা ইংরেজি শিখলে অথবা বিজ্ঞান পড়লে সে ‘পশ্চিমায়িত’ হয়ে যায়।
কিন্তু আমি বলেছিলাম, ‘শিক্ষা হলো শিক্ষা। আমাদের সবকিছু শিখে যে পথ ভালো, সে পথ নির্বাচন করা উচিত। শিক্ষা পশ্চিমাও না প্রাচ্যীয়ও না, শিক্ষা মানবিক।
মিডিয়ার সামনে মা আমাকে মুখ ঢাকতে বলতেন, কারণ এই বয়সে আমার পর্দা করা উচিত এবং মা আমার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো আমাকে কোনো কিছু করতে বারণ করেননি। সেটা ছিল ভয় আর আতঙ্কের কাল। মানুষ প্রায়ই বলত তালেবান আমাকে মারবে না, মারবে আমার বাবাকে। ‘মালালা এখনো শিশু,’ তারা বলত, ‘আর তালেবান বাচ্চাদের মারে না।’
কিন্তু আমার নানি এত নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি যখনই আমাকে টেলিভিশনে কথা বলতে দেখতেন বা বাসা থেকে বের হতে দেখতেন, তিনি প্রার্থনা করতেন, ‘সৃষ্টিকর্তা দয়া করে মালালাকে বেনজির ভুট্টোর মতো বানাও, কিন্তু বেনজিরের মতো স্বল্পায়ু তুমি তাকে করো না।’
স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও আমি ব্লগে লেখা চালিয়ে গেলাম। মেয়েদের স্কুলের নিষেধাজ্ঞার চার দিন পর আরো পাঁচটা স্কুল ধ্বংস করা হলো। ‘আমি অত্যন্ত বিস্মিত’, আমি লিখলাম, ‘কারণ এই স্কুলগুলো তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেন তাদের ধ্বংস করার প্রয়োজন হলো? তালেবানের ডেডলাইনের পর কেউই স্কুলে যায়নি। সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে কিছুই করছে না। তারা পাহাড়ের ওপর তাদের বাঙ্কারে বসে আছে। তারা ছাগল জবাই করে জমা করে খায়। মোল্লা এফএম-এ প্রচারিত বেত্রাঘাত দেখতে মানুষের যাওয়ার কথাও লিখলাম এবং কোথাও পুলিশের টিকিটিও দেখা না যাওয়ার কথাও লিখলাম। একদিন আমরা আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর কাছ থেকে কল পেলাম। সে ইসলামাবাদের মেয়ে, নাম শিজা শাহিদ। সে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্লাস ডিসমিসড ইন সোয়াত ভ্যালি’ বা ‘সোয়াত উপত্যকায় ক্লাস বন্ধ’ দেখে আমাদের ঠিকানা খুঁজে বের করেছে। তখন আমরা গণমাধ্যমের ক্ষমতাটা দেখলাম এবং সে আমাদের জন্য বড় অবলম্বন হয়ে উঠল আমার প্রামাণ্যচিত্রের ব্যাপারটা নিয়ে বাবা গর্বে ফেটে পড়ছিলেন। ‘দেখো ওকে’ তিনি অ্যাডাম এলিককে বললেন। ‘তোমার কি মনে হয় না সে আকাশচুম্বী হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে?’
অ্যাডাম আমাদের ইসলামাবাদ নিয়ে গেলেন। সেই প্রথম আমি ইসলামাবাদ গেলাম। সুন্দর সাদা বাংলো এবং প্রশস্ত রাস্তাসংবলিত ইসলামাবাদ খুবই সুন্দর জায়গা, কিন্তু সোয়াতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কিছুই এখানে নেই। আমরা অবরোধ হওয়ার সেই স্থান লাল মসজিদ দেখলাম, জারদারির বর্তমান বাসস্থান পার্লামেন্ট হাউস এবং প্রেসিডেন্সির সারি সারি স্তম্ভের পথে বিশাল কন্সটিটিউশন এভিনিউ দেখলাম। জেনারেল মুশাররফ তখন লন্ডনে নির্বাসনে ছিলেন।
আমরা দোকানে গিয়ে স্কুলের বই কিনলাম এবং অ্যাডাম আমাকে ‘আগলি বেটি’র মতো আমেরিকান টিভি অনুষ্ঠানের ডিভিডি এনে দিল, যেখানে আত্মবিশ্বাসী ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এক মেয়ের গল্প ছিল। আমি সেটা খুব পছন্দ করলাম এবং তার মতো একদিন নিউইয়র্কে গিয়ে একটা ম্যাগাজিনে চাকরি করার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। আমরা লোক ভিরসা জাদুঘরে গেলাম, এবং আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে আবারও উদযাপন করাটা খুবই আনন্দের ছিল। সোয়াতে আমাদের নিজেদের জাদুঘর বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে সিঁড়িতে এক বৃদ্ধ খই বিক্রি করছিলেন। তিনিও আমাদের মতই পশতুন, এবং বাবা যখন জিজ্ঞেস করলেন তাঁর বাড়ি ইসলামাবাদেই কি না, তিনি উত্তর দিলেন, ‘আপনার কি মনে হয়—ইসলামাবাদ কখনো আমাদের পশতুনদের হতে পারে?’ তিনি বললেন যে তিনি মোহমান্দ থেকে এসেছেন, যেটা একটা উপজাতীয় এলাকা, কিন্তু সামরিক অভিযানের ফলে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। আমি আমার মা-বাবার চোখে অশ্রু দেখলাম।
অনেক বিল্ডিং কংক্রিট ব্লক দ্বারা ঘেরাও করাছিল, এবং আত্মঘাতী বোমার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বহিরাগত যানবাহনের জন্য চেক পয়েন্টের ব্যবস্থা ছিল। ফেরার পথে বাসটা একটা ছোট গর্তের সঙ্গে ধাক্কা খেলে আমার ভাই খুশাল ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বলে, ‘ওটা কি একটা বোমা বিস্ফোরণের ঝাঁকুনি?’ এই ভয়ই আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করত। যেকোনো ছোটখাটো ধাক্কা বা শব্দই বোমা বা গুলি হতে পারে।
আমাদের ছোট ভ্রমণগুলোয় আমরা সোয়াতে আমাদের সমস্যার কথা ভুলে যেতাম। কিন্তু উপত্যকায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা আবার হুমকি আর বিপদের সীমারেখায় প্রবেশ করলাম। তবু সোয়াত আমাদের বাড়ি এবং আমরা সোয়াত ছাড়তে তৈরি ছিলাম না।
মিঙ্গোরায় ফিরে আমি প্রথমেই ওয়ার্ডরোব খুলে আমার ইউনিফর্ম দেখলাম, দেখলাম আমার স্কুল ব্যাগ এবং জিওমেট্রি বক্স। আমার খুব খারাপ লাগল। ইসলামাবাদে ভ্রমণটা খুব সুন্দর একটা বিরতি ছিল, কিন্তু এখন এটাই আমার বাস্তবতা।