অমল ও রবীন্দ্রনাথ
ভীষণ ঝড়। কালবৈশাখী ঝড়।
প্রচণ্ড ঝড়ে লম্বা গাছপালা নুয়ে মাটিতে সেজদা দিচ্ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের ঠমকে মুহূর্তের মধ্যে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। টিনের চালের ওপর বিপুল শব্দে একটা কিছু পড়েছে। ভয়ে অমল মাকে জড়িয়ে ধরে। বারান্দা থেকে বাবা দৌড়ে আসে, ভয় পাসনে অমল।
চড় চড় চড়াৎ...মনে হয় নারকেলগাছ থেকে নারকেল পড়েছে টিনের চালে।
গোয়ালে গরুগুলো তারস্বরে চিৎকার করছে হাম্বা...হাম্বা...। জানালার ফাঁক গলে বাইরে তাকিয়ে অমল অবাক, বাতাস এত জোরে বয় কীভাবে? বাতাস এত শক্তি কই পায়? বাড়ির সামনের বড় শিরীষগাছটাকে আছড়ে ফেলে দিয়েছে শন শন শন বাতাস।
মা আর বাবা মিলে গেছে গোয়ালঘরে। অমল ঘরে একটা জানালায় চোখ রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে। গাছের পাতারা বাতাসের তোড়ে ছটফট করছে। হঠাৎ মনে পড়ল আমগাছের আমগুলোকে। হায় হায়, ঝড়ে সব আম কি পড়ে গেছে? পাশের বাড়ির বলাই কি কুড়িয়ে নেবে? অনেকক্ষণ পর কালবৈশাখী থামলে অমল চুপিচুপি ঘর ছেড়ে বাগানে যায়। বলাইয়ের আগে আমগুলো কুড়াতে হবে। বাগানের পূর্ব দিকের আমগাছটার আম খুব মিষ্টি। লবণ ছাড়াই এই গাছটার কাঁচা আম খেতে দারুণ লাগে।
দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে অমল বাগানের দিকে হাঁটতে থাকে।
ওমা! আমগাছের কাছে যেতেই দেখে, এক বুড়ো আম কুড়াচ্ছে। আম কুড়িয়ে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে রাখছে। বুড়ো বেশ লম্বা। মাথার ঘন চুল একটু একটু সাদা। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে বুড়োর গোটা শরীর। কিন্তু সেদিকে দিকপাত নেই বুড়োর। একমনে আম কুড়াচ্ছে আর ব্যাগে ভরছে। রাগে অমলের শরীর জ্বলছে। বুড়ো এলোই কেমন করে? বুড়োর কি ভয়-ডর নেই? এই বাগানের পাহারাদার হরিনারায়ণ যদি দেখে বুড়োকে, কী যে করবে!
এ্যাই! তুমি কে? অমল একটু কাছে এসে ধমক দেয়।
কী আশ্চর্য! বুড়ো একবার তাকিয়ে একটু হেসে আবার আম কুড়াতে কুড়াতে ওকে ডাকে ইশারায়। অমল কাছে গেলে বুড়ো হাসতে হাসতে বলে, দাঁড়িয়ে কেন? আম কুড়াও।
তার আগে বলো তুমি কে? তুমি কেন বাগানের আম কুড়াচ্ছো? আর তুমি এলেই বা কোত্থেকে? তোমাকে যদি জমিদারবাড়ির পাহারাদার হরিনারায়ণ দেখে, তখন বুঝবে আম কুড়ানোর মজা, হ্যাঁ বলো—তুমি কে?
আমি? বুড়োর মুখে মিটিমিটি হাসি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি কে? রাগ বাড়ছে অমলের। বুড়ো মোটেই পাত্তা দিচ্ছে না ওকে।
তার আগে বলো তুমি কে? কী অবাক কাণ্ড, বুড়ো উল্টো প্রশ্ন করছে। আরে, এই তল্লাটের কে না চেনে অমলকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাকে ডাকঘর নাটকে বিখ্যাত করে রেখেছেন। এই বুড়োর দেখি লেখাপড়ার বালাই নাই। কোত্থেকে আসছে কে জানে!
বললে না, তুমি কে? বুড়ো আবার প্রশ্ন করে।
আমি অমল।
কোন অমল?
তুমি কোন অমলকে চেন?
আমি অনেক অমলকে চিনি। নন্দীপাড়ার অমল, ঘোষপাড়ার অমল, কুমোরপাড়ার অমল, শেখবাড়ির অমল, উজানগাঁওয়ের অমল, সখিপুরের বেঁটে অমল। পাশের গ্রামেও আছে কয়েকজন অমল।
আমি সেই অমলদের কেউ না।
তাহলে তুমি কোন অমল?
আমি রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের অমল।
রবীন্দ্রনাথ! বুড়োর চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস, কোন রবীন্দ্রনাথ?
তুমি কোন রবীন্দ্রনাথকে চেন? মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে অমল। বুড়োর জন্য আম কুড়াতে পারছে না। কালবৈশাখী ঝড় প্রায় থেমেছে। যদিও হালকা বাতাস বইছে। যেকোনো সময়ে চলে আসতে পারে বলাই। বলাই এলে ও ঝড়ের মতো সব আম কুড়িয়ে নেবে। একটা আমও থাকবে না। বলাইয়ের সঙ্গে শক্তিতেও পারে না অমল। বলাইয়ের তাগড়া শরীর। ছোটে ষাঁড়ের মতো। হাঁটে কালাপাহাড়ের মতো। আর দেখো বুড়ো এখনো কথা বলছে। আম কি কুড়াতে পারবে? ওদিকে গোয়ালঘর থেকে মা ঘরে এলে ওকে না দেখলে ডেকে ডেকে পাগল হয়ে যাবে। এতসব ঝামেলা কি বুঝবে বুড়ো? ওমা, বুড়ো ঝোলার ভেতর থেকে পানের বাটা বের করছে দেখছি।
খাবে নাকি একখান পান? বুড়ো পাশেই পাকা বেঞ্চে বসে। মনে হচ্ছে এই বাগানবাড়ি তার অনেক চেনা। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে পান বানিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে শুরু করে।
না, আমি পান খাই না। কিন্তু তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।
কী প্রশ্ন তোমার?
তুমি কোন রবীন্দ্রনাথকে চেন?
আমি এক রবীন্দ্রনাথকে চিনি, কথা বলতে বলতে বুড়ো পানের পিক ফেলে—সেই রবীন্দ্রনাথ ছিল পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার ঠাকুর পরিবারে বারোশত আটষট্টি বঙ্গাব্দে।
অমল অবাক হয়ে বুড়োর দিকে তাকায়, আমিও তো সেই রবীন্দ্রনাথের কথা বলছি।
তাই!
হ্যাঁ। অমল কথা বলতে বলতে পাশে বসে, জানো, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক গল্প-কবিতা লিখেছেন। এই আমাকে নিয়ে লিখেছেন চমৎকার এক নাটক ‘ডাকঘর’।
আচ্ছা, তুমি সেই ডাকঘরের অমল?
তুমি আমাকে চেন নাকি?
হাসতে হাসতে বুড়ো সেই আমগাছের নিচে ভেজা পাতার ওপর এক পাক নেচে আবার বসে অমলের পাশে, আরে আমাকে চিনতে পারছো না অমল? আমি দই নিয়ে যেতাম আর তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দইঅলা, ও দইঅলা বলে ডাকতে আমাকে, মনে নেই?
দূর! তোমাকে দইঅলার মতো মনেই হয় না। তোমাকে বরং রবীন্দ্রনাথের মতোই লাগে। সেই লম্বা, মাথা উঁচু, ঘন ভ্রূ, চওড়া কপাল, কাঁধের ওপর ছড়ানো চুল, মাঝখানে সিঁথি, বিরাট আলখেল্লা তোমার গায়ে, তুমি আসলে রবীন্দ্রনাথ।
হাত বাড়ায় রবীন্দ্রনাথ, তুমি কী করে বুঝলে?
বুঝব না কেন? তুমি মহান এক শিল্পী। তোমাকে এ দেশের মাটি, জলবায়ু, গাছপালা, পাখি, নদী, আকাশ সবাই চেনে। তুমি না লিখেছ, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...। তোমার মতো কেউ কি লিখেছে এমন? কিন্তু তুমি আমাকে বড় করোনি কেন ডাকঘরে? অসুস্থ বানিয়ে একটা ঘরে রেখে দিলে কেন? এতদিন ঘরে থাকতে আমার কষ্ট হয় না?
রবীন্দ্রনাথ হাত রাখেন অমলের কাঁধে, আমি তো আসলে একজন অমলের মাঝে হাজারো অমলকে আঁকতে চেয়েছি। এই দেশে কত অমল আছে স্বপ্ন দেখে, যারা বড় হতে চায়, যারা ছোট্ট ঘর ভেঙে ঘরের বাইরে আসতে চায়, যারা ভরদুপুরের রোদের ছায়ায় বসে দইঅলার সঙ্গে গল্প করতে চায়, যারা ঝড়ের দিনে আম কুড়াতে চায়, যারা বাদলা দিনে কেয়াপাতার নৌকা ভাসাতে চায়, যারা দস্যিদের কবল থেকে তাদের মাকে বাঁচাতে তরবারি হাতে লড়াই করতে চায়, যারা বৈশাখ মাসে নদীর হাঁটুজল পার হয়ে যায়, যারা আঁচলে ছাঁকিয়া ছোট মাছ ধরে... তুমি তো সেই চিরকালের অমল। তোমার মাঝে বেঁচে আছে অনেক অনেক অমল।
বাহ! তুমি তো আমার মনটা ভালো করে দিলে। অমল হাসে, আমার মাঝে অনেক অনেক অমল বেঁচে থাকবে, ভাবতেই এখন আমার খুব ভালো লাগছে। জানো, এতদিন না তোমার ওপর আমার খুব রাগ ছিল।
এখনো আছে?
না, একদম নেই। আচ্ছা...
কী?
তুমি এই শাহজাদপুরে এতদিন পরে এলে কীভাবে?
কেন? আমার বোটে পদ্মা পার হয়ে এলাম। কিন্তু দুঃখ কি জানো অমল, পদ্মার সেই স্রোত নেই। সেই ভয়-ধরানো উথালপাথাল ঢেউ নেই। পদ্মা মরে গেছে।
বুড়ো তুমি কিচ্ছু জানো না, অমল মাথা ঝাঁকায়—পদ্মাকে মেরে ফেলেছে মানুষ।
মানুষ এমন কেন?
উদাস তাকায় অমল, মানুষ আসলে এমনই।
থাক, মানুষ নিয়ে কথা কয়ে আর আমাদের কাজ নেই। আজ যখন আম খাওয়া উপলক্ষে দুজনের দেখা হলো, তখন এসো আম খাই।
কাঁচা আম খেতে পারবে?
হাসে রবীন্দ্রনাথ, খুব পারব। তুমি তোমার ছুরিটা বের করো। আম কাটি। জানো তো, এই আমগাছটার আম খুব মিঠা। আমের দিনে আমি বারান্দায় বসে লিখতাম। আর চেয়ে চেয়ে দেখতাম আমগাছের পাকা সিঁদুর রং আম। পাকা আমগাছের নিচে পড়লে আমাকে ফালি ফালি করে হরিনারায়ণ কেটে দিত। কী যে মিষ্টি আর মধুর ছিল সেই পাকা আম, তোমাকে বোঝাতে পারব না। এতদিন পরেও সেই দিনগুলো আমার খুব মনে পড়ে। ইচ্ছে হয়, আবার ফিরে আসি।
আসবে? অমল হাত ধরে, এসো। আমি অসুখ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি দুপুরের উদাস রোদে দই নিয়ে আসবে। আমি ডাকব দইঅলা, ও দইঅলা...।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রবীন্দ্রনাথ, নাহ অমল, সেটা আর সম্ভব নয়। থাক ওসব। এসো কাঁচা আম খাই।
অমল কোঁচড় থেকে আম খাওয়ার ছুরিটা কেবল বের করে—তুমি পারবে না আম কাটতে। আমাকে দাও, আমি কাটি।
আরে না, আমি যখন অমল ছিলাম তখন কত আম কেটেছি আর খেয়েছি!
রবীন্দ্রনাথ ছুরি দিয়ে আম কাটতে লাগলেন। পাশে বসে কৌতুকভরা চোখে দেখছে অমল।
কী, আম কাটতে পারছি?
রবীন্দ্রনাথের কথায় মাথা ঝাঁকায় অমল—আসলে অমলরা কিছুই ভোলে না।
হেসে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ, তুমি ঠিকই বলেছ।
রবীন্দ্রনাথ আম কাটতে থাকেন। অমল কলাপাতা ছিঁড়ে আনে। রবীন্দ্রনাথ কাটা আম কলার পাতার ওপর রাখেন। দুজনে আম খেতে শুরু করে। কাঁচা আমের টকে রবীন্দ্রনাথের মুখ জলে ভরে ওঠে। মুখ আর ঠোঁট বাঁকা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন—অমল, যদি একটু লবণ হতো!
আমিও সেটা ভাবছিলাম, মুখ চোঙ্গ করে বলে অমল।
হরিনারায়ণ ঢোকে বাগানে। হাতে তার বিশাল লাঠি। কে? আমতলার আম কে কে কুড়াচ্ছে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। আজকে তোদের একদিন কি আমার একদিন।
বিরাট লাঠি হাতে হরিনারায়ণকে আসতে দেখে আম কুড়ানো বলাই, রতন, ফটিক, মাখন পড়িমরি ছুটে পালাচ্ছে। হরিনারায়ণ আমগাছের নিচে এসে হাঁপায়—জমিদার বাবুকে আমের হিসাব দিতে হবে না বুঝি? হতচ্ছাড়ারা সব আম নিয়ে গেল। এখন আমি জমিদার বাবুকে কী বলব?
পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ আর অমল হাসে আর আম খায়।
হরিনারায়ণ কতক্ষণ বকব্ক করে পরে কয়েকটি আম নিয়ে চলে যায়। হঠাৎ একটা সুর ভেসে আসে, আমি কোথায় পাব তারে... আমার মনের মানুষ যে রে...।
রবীন্দ্রনাথ চমকে ওঠেন, অমল? এটা গগন হরকরার গলা না?
সেটাই তো মনে হচ্ছে, অমল টক-মাখানো ঠোঁট চাটতে চাটতে জবাব দেয়।
চলো তো, ওকে একটু দেখে যাই।
চলো।
দুজনে হাঁটতে থাকে ভেজা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে, গগন হরকরার গানের সুর অনুসরণ করে।