পনেরোর বিশ্ব
২০১৫ সালের শেষ সূর্য অস্ত গেছে বহু দেশেই। বছরের শেষ প্রহরে দাঁড়িয়ে ২০১৬ সালের নতুন ভোর দেখার অপেক্ষায় মশগুল বিশ্ব। এক ফাঁকে একবার চলুন ফিরে যাই পুরোনো বছরে। দেখে নিই, বিদায়ী বছরে ঘটে যাওয়া কয়েকটি এমন ঘটনা, যেগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে রেখেছিল গভীর প্রভাব, বদলে ফেলেছিল পৃথিবীর নৈমিত্তিক জীবনের চেনা ছক।
রক্তাক্ত শার্লি এবদো
বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শার্লি এবদো নামের একটি কার্টুন ম্যাগাজিনের দপ্তরে বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ম্যাগাজিনটির প্রধান সম্পাদক স্টেফান শার্বোনিয়ার, পত্রিকাটির তিন কার্টুনিস্ট এবং একজন পুলিশ । দুইদিন পরে একই ঘটনার জেরে আরো পাঁচজনসহ মোট ১৭ জন নিহত হওয়ার পর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। ৪৪টি দেশের নেতারা যোগ দেন সেই প্রতিবাদ সমাবেশে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ ওলাঁদ শার্লি এবদোর দপ্তরে হামলাকে একটি 'বর্বর সন্ত্রাসবাদী হামলা' বলে বর্ণনা করেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ব হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদমুখর।
বোকো হারামের নৃশংসতা
বিশ্বে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞের একটি ঘটে এ বছরের প্রথম সপ্তাহে। আফ্রিকার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম নাইজেরিয়ায় লেক চাদের কাছে অবস্থিত দুটি শহরে হামলা চালিয়ে কয়েক হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। নিহতের সংখ্যা এখনো নিশ্চিত না হলেও স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, দুটি শহরেরই বিশাল এলাকা হামলায় মাটিতে মিশে গেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনাটিকে বিশ্বে জঙ্গি হামলার ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য ঘটনা বলে আখ্যা হেয়। ঘটনাস্থল থেকে রয়টার্সের প্রতিনিধি জানায়, মৃতদেহ গুনে শেষ করা যাচ্ছিল না, দেহের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে অনেক আহতরা শেষ পর্যন্ত মারা যান। এছাড়া ২০১৫ সালের পুরোটা জুড়েই মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় হত্যাযজ্ঞ চালায় বোকো হারাম।
নেপালে প্রলংকরী ভূমিকম্প
এ বছরের ২৫ এপ্রিল দুপুরে হিমালয়কন্যা নেপালে আঘাত হানে এক প্রলংকরী ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ৭.৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় প্রায় ৯০০০ মানুষ। এ ছাড়া আহত হন প্রায় ২৩ হাজার মানুষ। ভেঙে পড়ে নেপালের ঐতিহাসিক সৌধ। তুষারধস নামে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে। এরপর, ভূমিকম্পের প্রভাব কাটিয়ে যখন ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছিল দেশটি তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নেপালের ওপর এক অলিখিত ‘অবরোধ’ আরোপ করে। সেই অবরোধে বছরব্যাপীই বিপর্যস্ত ছিল নেপালের স্বাভাবিক জীবনযাপন।
সমুদ্রে ভাসমান নৌকায় মানব
বছরের মাঝামাঝি এসে বিশ্বব্যাপী আরেক আলোচিত বিষয় ছিল বঙ্গোপসাগরে ভাসমান নৌকামানব। অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশে যাওয়ার সময় দালালদের চক্রান্তের শিকার হন অনেক বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। ট্রলারে করে এদের অনেকেই ভাসতে থাকেন বঙ্গোপসাগরে। আর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এদের আখ্যায়িত করে নৌকামানব নামে। সমুদ্রপথে মানবপাচার ও অভিবাসী সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসে।
দেউলিয়া গ্রিস
২০০৯ সাল থেকে গ্রিসে শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক মন্দা। ২০১২ সালে 'আইএমএফ' গ্রিসকে বৃহত্তম ঋণ দেয়, কিন্তু ২০১৫ সালের ৩০ জুন সেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় গ্রিস। ইউরোজোনের দেশগুলোর মধ্যে গ্রিস একমাত্র উন্নত দেশ, যারা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়। এতে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, ব্যাংক-এটিএম থেকে টাকা তোলায় আরোপ করা হয় নিয়ন্ত্রণ। এরপরও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া কৃচ্ছ্রসাধনের প্রস্তাব মানেনি গ্রিস। নিজের সিরিজা দলেই বিক্ষোভের মুখে পড়েও প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস কারো কাছে মাথা নত করতে চাননি। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ইস্তফা দেন সিপ্রাস। নির্বাচনে জিতে ফের ক্ষমতায় বামপন্থী সিরিজা দল। প্রধানমন্ত্রী যথারীতি সিপ্রাস। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে কৃচ্ছ্রসাধনের প্রস্তাব মেনে নেয় আর্থিকভাবে ধুঁকতে থাকা গ্রিস।
শরণার্থী সমস্যা
বছরব্যাপী আরেকটি বড় সমস্যা ছিল উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়ে অন্তত ১০ লাখ উদ্বাস্তু। অর্ধেকই সিরিয়া থেকে। বাকিরা আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তান, ইসরায়েল, নাইজেরিয়ার। তুরস্ক থেকে গ্রিসের লেসবস দ্বীপে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে নিহত হয় তিন হাজার ৭৩৫ জন। মায়ের কোল থেকে পানিতে পড়ে যায় ছোট্ট আয়লান কুর্দি। উদ্বাস্তু প্রবেশ রুখতে কড়া নীতি আরোপ করে নরওয়ে, সুইডেন সরকার। এ সময় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে স্বাগত জানায় জার্মানি।
বড় প্রশ্ন রেখে ছোট্ট আয়্লানের মৃত্যু
তুরস্কের উপকূলে লাল জামা গায়ে একটি ছোট শিশুর নিথর দেহ উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। ছবিটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র আলোড়ন তোলে। ইউরোপের শরণার্থী সংকট কতটা গভীর ওই ছবি যেন জানান দিচ্ছিল। শিশুটির নাম আয়লান কুর্দি। পাঁচ বছর বয়স তার। নৌকাডুবির পর আয়লান কুর্দির মরদেহ সৈকতে ভেসে আসে। এই ছবি প্রকাশের পর বিশ্বমানবতা যেন শরণার্থী সংকটের দিকে নতুন করে চোখ ফেরায়। শরণার্থীদের জন্য রাতারাতি উন্মুক্ত হয় অনেক দেশের দরজা। তবে বছরের শেষভাগে এসেও শরণার্থী সমস্যা বিশ্বের অন্যতম অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবেই রয়ে গেছে।
হজযাত্রায় মৃত্যুমিছিল
২৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের মক্কায় পবিত্র হজ যাত্রায় মিনায় শয়তান স্তম্ভে পাথর ছুঁড়তে যাওয়ার পথে গুজব থেকে ধাক্কাধাক্কি হয়। পদপিষ্ট হয়ে নিহত হন ৭৬৯ জন (সরকারি হিসাবে)। জখম হন ৯৩৪ জন। বেসরকারি সূত্রে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৪১১। আহত ৯০০-র ও বেশি মানুষ। ঘটনার পর বহু মাস পেরিয়ে গেছে তবু আজও খোঁজ মেলেনি ৬৫০ জনের।
সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান হামলা
অক্টোবর থেকে মার্কিন জোটের সঙ্গে সিরিয়ায় বিমান হানা শুরু করে রাশিয়া। যদিও সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছিল, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের নির্মূল করে বাশার আল আসাদকেই সাহায্য করছে রাশিয়া। রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে আইএসকে সাহায্য করার। এই বাক্যালাপের মাঝে ন্যাটোভুক্ত দেশ হয়ে সিরীয় সীমান্তে গুলি করে রুশ যুদ্ধবিমান নামায় তুরস্ক। ১৯৫০ সালের পর থেকে এমন সাহস দেখায়নি বিশ্বের কোনো দেশ। ওই অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় প্রহর গুণতে শুরু করেছিল বিশ্ব। সীমান্তে সেনা-সমরাস্ত্রও জড়ো করতে শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।
রুশ বিমান দুর্ঘটনা
৩১ অক্টোবর সিনাইয়ের উত্তরে ভেঙে পড়ে রুশ বিমান মেট্রোজেট- ৯২৬৮। সওয়ার ২১৭ জন যাত্রী এবং সাতজন কর্মীই নিহত। মিসরের শারম আল শেখ থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাচ্ছিল। দুর্ঘটনার পরই টুইটারে দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন আইএসের সিনাই শাখা। ১৭ নভেম্বর তা মেনে নেয় রাশিয়া।
সুচির ‘পুনর্জন্ম’
১৯৯০-এ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পরও অং সান সুচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি দলটিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়নি মিয়নমারের সামরিক সরকার। বাকস্বাধীনতার আন্তর্জাতিক প্রতীক নোবেলজয়ী সুচিকে ১৫ বছর গৃহবন্দী থাকতে হয়।
২০১৫ এর নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে কিন্তু দীর্ঘ ২৫ বছর পর আবার জয়ী হয় সুচির দল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ উড়িয়ে দেন সামরিক শাসনের অবরোধ। কিছু আইনী বাধা দিয়ে রাখলেও এবার সুচির গৃহবন্দীকারী সেনাপ্রধানরাও মেনে নিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল। তবে ৩টি মন্ত্রণালয় এবং সংসদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসন নিজেদের অধীনে রেখেছেন সেনাশাসকরা। তা থাকুক। তবে দীর্ঘ বছরের সংগ্রামের পর সুচি পান মুক্তির আনন্দ, দেশের জনগণকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো একে সুচির ‘পুনর্জন্ম’ বলে আখ্যা দেয়।
কবিতার শহরে রক্তের ছাপ
ফ্রান্সের প্যারিসে ১৩ নভেম্বর জঙ্গি সংগঠন আইএসের হামলায় ১৩০ জন নাগরিক প্রাণ হারান। ছবি আর কবিতার দেশের ওপর এমন নৃশংস হামলার প্রতিবাদে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো শপথ নিল, সিরিয়া ও ইরাকে আকাশ-জলপথে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের নির্মূল করে দিতে হবে। আর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোর বিমান বছরের শেষভাগজুড়ে সিরিয়ায় যৌথ হামলা চালিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে আইএস আতঙ্ক
২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী অন্যতম আলোচিত শব্দ ছিল আইএস। বিশেষ করে প্যারিসে সিরিজ সন্ত্রাসী হামলার পর বিশ্বজুড়ে শুরু হয় আইএস আতঙ্ক।ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলোতেও এমন হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভঁলস। এরপর এক ভিডিও বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রেও বড় ধরনের হামলা করা হবে বলে আইএসের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হলে আতঙ্ক বাড়ে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেন, আরব বিশ্বের বাইরেও যে আইএস হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে, প্যারিসে হামলার ঘটনা তারই প্রমাণ। আইএস দেখিয়েছে, তারা যেকোনো সময়ে যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে সক্ষম। পাশাপাশি তাদের হামলা প্রতিরোধে ইউরোপের আধুনিক শহরগুলো অনেকটাই ব্যর্থ। আর এ কারণে আইএস নিয়ে আতঙ্ক আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র। তাই আইএস হামলার আশঙ্কায় ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ‘অসহিষ্ণুতা’
২ ডিসেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নারদিনোয় সমাজসেবা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে ১৪ জনকে গুলি করে খুন করে পাক বংশোদ্ভূত দম্পতি। তার পরই আমেরিকায় সংখ্যালঘুরা নানাভাবে আক্রান্ত হয়। জাতির উদ্দেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ভাষণও কাজে আসেনি। এদিকে আবার বিড়ম্বনা বাড়ান রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেন, মুসলিমদের দেশে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়।
বিশ্বের জন্য সম্মেলন
বছরের শেষদিকে এসে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। দীর্ঘ টানাপড়েন, দর কষাকষির পর ১২ ডিসেম্বর প্যারিসে গৃহীত জলবায়ু সংক্রান্ত সমঝোতাপত্র। সম্মতি জানায় ১৯৫টি দেশসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সম্মেলনে যোগ দিয়ে ১৪৭ দেশের রাষ্ট্রনায়করা একত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ হন, আগামী দিনে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো মারণ গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনা হবে। বিশ্বের উষ্ণতা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না।