ক্রীড়াঙ্গনের ‘প্রিয় খোকা ভাই’ বেঁচে থাকবেন চিরদিন
সাদেক হোসেন খোকা, এক বর্ণাঢ্য ও ব্যতিক্রমী চরিত্রের অধিকারী। রণাঙ্গনের অকুতোভয় সৈনিক থেকে একজন ক্রীড়া সংগঠক, জননেতা, সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব— কোথায় ছিলেন না তিনি। জীবনের প্রতিটি স্তরে নানামুখী কর্মতৎপরতায় নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। অত্যন্ত মানবিক গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের একজন সফল সংগঠক এবং ক্রীড়াবিদদের অভিবাবকও ছিলেন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে মিশে থাকবেন ‘প্রিয় খোকা ভাই’। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি ছিল তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা এবং এই ক্রীড়াঙ্গনকেই বিবেচনা করতেন নিজের শেষ ঠিকানা হিসেবে।
ছাত্র জীবনেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সাদেক হোসেন খোকা। তবে আরো আগে থেকেই খেলাধুলার প্রতি তার ভালোলাগা-ভালোবাসা শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ১৯৭১ সালে যুদ্ধের দামামা শুরু হলে; বাড়ির কাউকে না জানিয়ে চলে যান রণাঙ্গনে। দেশ স্বাধীন করেই ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমিতে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে দুজন ভার্সেটাইল চরিত্রের মধ্যে একজন হলেন শেখ কামাল, অন্যজন সাদেক হোসেন খোকা। দুজনই মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যুবসমাজ এবং ক্রীড়াঙ্গনের পুনর্গঠনে নানামুখী অবদান রেখেছেন।
সাদেক হোসেন খোকা যা কিছু অর্জন করেছেন নিজের মেধা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে।
গোপীবাগের যুব সমাজকে মাদক থেকে ক্রীড়ামুখী করতে তাঁর ভূমিকা ছিল আনেক বড়। তাঁর প্রিয় রাজনীতিবিদ মরহুম সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিককে নিয়ে হাল ধরেন ব্রার্দাস ইউনিয়ন ক্লাবের। তারুণ্যের জয়গানে মুখরিত করে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নকে দেশের অন্যতম সেরা ক্লাবে পরিণত করেন। পাকিস্তানের সাবেক ফুটবলার গফুর বেলুচকে ফুটবল কোচের দায়িত্ব দেন তিনি। পাকিস্তানি একজনকে ফুটবল কোচ করায় বিতর্ক তৈরি হলেও, তিনি তাতে দমে যাননি। পরবর্তী সময়ে এই গফুর বেলুচই ব্রার্দাসের সাফল্যের অন্যতম নায়কে পরিণত হয়েছিলেন।
ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের উত্থানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাদেক হোসেন খোকা। শুধু তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রসহ পুরোনো ঢাকার আরো ৫-৬টি ক্লাবের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।
আশির দশকের শুরুতে ফুটবল উন্নয়নে ঢাকা মেট্রোপলিস ফুটবল অ্যসোসিয়েশন গঠনে বড় অবদান রেখেছিলেন তিনি। তিনি ডামফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘরোয়া ফুটবলে নানামুখী আবদান রেখেছেন। ফুটবল সংগঠক হারুনুর রশিদের নিয়ে তৃণমূল থেকে ফুটবলার তুলে আনতে চালু করেন পাইওনিয়ার ফুটবল লিগ। ফিফার তখনকার সভাপতি জোয়াও হ্যাভেল্যাঞ্জ এই লিগ উদ্ধধোন করতে এসে বিস্মিত হন। একটি দেশের চতুর্থ ডিভিশনে ৮০টি দল খেলছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিগ। এটা দেখে ফিফা সভাপতি এই লিগের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এই লিগ পরবর্তী সময়ে দেশকে উপহার দিয়েছে দারুণ কিছু ফুটবলার। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই লিগ কয়েক বছর বন্ধ থাকায়, তিনি ঢাকার মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে সিটি করপোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই লিগকে আবার নতুন জীবন দেন। তিনি ১০ বছরের জন্য লিগের পৃষ্ঠপোষতার চুক্তি করে যান।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে ক্রীড়াঙ্গনের প্রত্যাশা মতোই তিনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং পরবর্তী পাঁচ বছর দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সফলভাবে নেতৃত্ব দেন। তাঁর সময়ে হকির জন্য একটি আধুনিক স্টেডিয়াম, মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্স, ইনডোর স্টেডিয়ামসহ ক্রীড়ার উন্নয়ণে অনেক অবকাঠামো নির্মিত হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে এসএ গেমসের সফল আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। সেই গেমসে বাংলাদেশ বড় সফলতার স্বাক্ষর রাখে। তিনি দলমতের উর্ধ্বে উঠে প্রকৃত ক্রীড়াসংগঠকদের বিভিন্ন ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিলেন। সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে তিনিই বিসিবিতে নিয়ে এসে সহসভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি একজন দেশপ্রেমিক এবং অত্যন্ত উদার মনের আলোকিত মানুষ ছিলেন। অসাধারণ সব মানবিক গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। সবার সঙ্গেই সহজেই মিশতে পারতেন। অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি সারা জীবন দেশের ক্রীড়াবিদদের পাশে ছিলেন এবং যাঁর যে সহায়তা প্রয়োজন ছিল তা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সফল আয়োজনে মিরপুর স্টেডিয়াম এলাকার রাস্তা ও পরিবেশ উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন তিনি। ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির বর্তমান জায়গাটি পেতে তিনি নানাভাবে সহায়তা করেছেন। ডিআরইউর ক্রীড়া উৎসবেও পৃষ্ঠপোষকতা করে সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর ভালোভাসার সৌরভ ছড়িয়েছেন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের ক্রীড়াবিদদের উৎসাহিত করতে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার প্রচলন করেছিলেন। আর সাদেক হোসেন খোকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার প্রদান করে ক্রীড়াবিদদের সম্মানীত করেছেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখায় ২০০৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি। তিনি প্রকৃত অর্থেই এক ভিন্ন মাত্রার মানুষ ছিলেন। তিনি মৃত্যুর পরও তাই দলমত নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা ও ভালোভাসা পাচ্ছেন। এটাই প্রমাণ করে তিনি কত জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন।
দেশের ক্রীড়াবিদরা যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছেন, তাদের শেষ ভরসাস্থল ছিলেন ‘প্রিয় খোকা ভাই’। তিনি আজ নেই। তবে তিনি সবার হৃদয়ে থাকবেন সবসময়।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, বাংলাভিশন