খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে যা হলো
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এতে করে কারাগারেই থাকতে হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। শুনানিকে কেন্দ্র করে আদালত অঙ্গনে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই করে আইনজীবীদের আপিল বিভাগে প্রবেশ করানো হয়।
আজ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে আদালত খালেদা জিয়ার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
সকাল ১০টা ১০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, উভয়পক্ষে ৩০ জন করে আদালতে থাকেন। এর ১০ মিনিট পর মামলার শুনানি শুরু হয়। শুরুতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বেঞ্চ অফিসারকে বলেন, মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে আসেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে আদালতে আসেন। তখন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রিপোর্টটি দেখেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দু’টি রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করেন। একটি দুই মাস আগের, অপরটি এক সপ্তাহ আগের আদালতের নির্দেশে মেডিকেল বোর্ডের করা। পরে বিএনপির আইনজীবীদের উপস্থাপন করা রিপোর্ট দেখেন।
এ সময় অ্যার্টনি জোনরেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘উনারা হাতের লেখা কপি জমা দিয়েছেন।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাথাব্যাথা তো আমাদের। উনাদের নেই। আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি দেখা করার জন্য। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনকেও দেখা করতে দেওয়া হলো না। আমরা তো এ রিপোর্ট বানাইনি। খালেদা জিয়ার কী অবস্থা তাঁরা তা জানায়নি। মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়া হাত-পা নড়াচড়া করতে পারেন না। তাঁর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিছুটা বেশি। দিন দিন শরীর ড্যামেজ হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে পঙ্গুত্বের দিকে যাচ্ছেন। প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার। কিন্তু খালেদা জিয়ার অনুমতি ছাড়া নতুন কোনো মেডিসিন পুশ করা যাচ্ছে না।’
খালেদা জিয়া সুস্থ অবস্থায় হেঁটে হেঁটে কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন মন্তব্য করে তাঁর আইনজীবী বলেন, ‘তিনি এখন এতই অসুস্থ যে, পুরোপুরি পঙ্গু অবস্থায় চলে গেছেন, ছয় মাস পর তো তাঁর লাশ বের হবে। ওপরে আল্লাহ আছেন আর আপনারা এখানে আছেন, আর কাউকে বলার জায়গা নেই। আমরা বারবার জামিনের জন্য আসছি এ কারণেই যে, তিনি ৭৫ বছরের একজন নারী, ২২ মাস যাবৎ জেলে আছেন। মানবিক কারণে তাঁর জামিন চাই।’
শুনানি চলার মধ্যে বেলা ১১টা দিকে আদালত বিরতিতে যান। পরে বেলা সাড়ে ১১টা পুনরায় শুনানি শুরু হয়।
শুরুতেই কথা বলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, ‘এখানে রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব আছে। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেল রয়েছেন; তিনি তো রাষ্ট্রের, সরকারের নন। মেডিকেল রিপোর্টে খালেদা জিয়ার শরীরের কোনো উন্নতি নেই। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে সেদেশের সর্বোচ্চ আদালত জামিন দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা করেন। এখানে খালেদা জিয়াকে সাত বছর সাজা দিয়েছে। আইনের সর্বোচ্চ সাজা। আপনারা চাইলে জামিন কনসিডার করতে পারনে। আমাদের হাইকোর্ট তো মেডিকেল নিয়ে কোনো আদেশ দেয়নি।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা হাইকোর্টকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আপনারা তো ওখানে মেরিটে কথা বলেছেন।’
জবাবে জয়নুল অবেদীন বলেন, ‘আমরা মেরিটে কিছুই বলিনি। আইনে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।’ অনেক মামলার নথি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামির সাজা কমানো হয়েছে।’
এরপর আরেক আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করে বলেন, ‘আমাদের দেশে রাজনীতি আর জেল পাশাপাশি। সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন। জেলে প্রবেশ করলে তার চেয়ে আর খারাপ লোক আর নেই। যখন ক্ষমতায় থাকে তখন বিরোধীদল থেকে সেই অপবাদ দেওয়া হয়। খালেদা জিয়া অসুস্থ এ বিবেচনায় জামিন চাই।’
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করে শুনানি শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘রিপোর্ট অনুযায়ী, উনার হাতে-পায়ে ব্যথা। নড়াচড়া করতে সমস্যা হচ্ছে। তবে ১৯৯৭ সালে তাঁর হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করা হয়। তাঁর ডায়াবেটিস নরমালি রয়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জেলে যাওয়ার পর থেকে তাঁর ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে। তবে এসব রোগের চিকিৎসার জন্য উনার অনুমতি লাগে। খালেদা জিয়ার অনুমতি ছাড়া মেডিসিন দেওয়া যাচ্ছে না। খালেদা জিয়া যদি অনুমতি না দেন তাহলে কীভাবে ডাক্তার চিকিৎসা করবে। আমরা চাই, উনার সঠিক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হোক। জামিন দিলে অপর দুর্নীতিবাজরা মনে করবে; দুর্নীতি করলেও কিছুই হয় না।’
এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘মামলায় সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে। আপিল সাজা থাকাবস্থায় জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি হচ্ছে, উনি কী চিকিৎসা নিবেন কিনা? আমার বাসায় ডাক্তার আনলাম। ডাক্তার বললো ওষুধ খেতে হবে। এখন আমি ওষুধ যদি না খাই, তাহলে ডাক্তারের কী করার আছে?’
এরপর আদালত শুনানি শেষে জামিনের ওপর আদেশ দেওয়া হবে বলে জানান। পাঁচ মিনিটের জন্য এজলাস থেকে নেমে বিচারকরা আবার এজলাসে উঠেন।
এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতিক্রমে এ মামলার জামিন আবেদন নিষ্পত্তি করলাম। তবে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দেওয়া খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতিক্রমে জামিন নাকচ করে দিচ্ছি। মেডিকেল বোর্ডকে তাঁর (খালেদা জিয়া) প্রপার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা নিতে বলছি।’
এদিকে, রায় ঘোষণার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। তাঁরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’সহ নানা স্লোগান দেন। অন্যদিকে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
আদালতকক্ষ থেকে বেরিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আদালত স্বীকার করে নিয়েছেন, খালেদা জিয়ার সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। তবু কেন জামিন দিলেন না, আমরা জানি না। কেন এই আদেশ দিয়েছেন, বিবেচনা করে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সগীর হোসেন লিয়ন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, রাশেদা আলীম ঐশীসহ অর্ধশত আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলমসহ অর্ধশত আইনজীবী রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার জামিনের আপিল শুনানিকে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে হাইকোর্ট এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আদালতের স্টাফ ও আইনজীবীদের পরিচয়পত্র দেখে তল্লাশি করে ভেতরে ঢুকতে দেয় পুলিশ। হাইকোর্টের তিনটি ফটকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আদালতের ভেতরে আপিল বিভাগে প্রবেশের আগে দুটি গেটে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থান নেন।
খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে আপিল বিভাগের তালিকাভুক্ত আইনজীবী ছাড়া হাইকোর্টের কোনো আইনজীবীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবী ছাড়া জুনিয়র বা হাইকোর্টের আইনজীবীদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। তবে আপিল বিভাগের তালিকাভুক্তকরণ না থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলরা প্রবেশ করেছেন। এ নিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাকবিতণ্ডা হয়।
আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতিকে বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেন, ‘আমাদের আইনজীবীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ সরকারি সব আইনজীবী প্রবেশ করেছেন।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব আইনজীবীর আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত নেই, তাঁদের প্রবেশ করতে অনুমতি দেব না।’
এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমি বৃদ্ধ বয়সে কি মামলার নথি কাঁধে করে হাঁটব? আমার জুনিয়র না এলে আমি শুনানি কীভাবে করব? এই যদি হয়, তাহলে আমরা মামলার শুনানি করব না।’
এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন আপিল বিভাগে প্রবেশের বিষয়ে একটি রায় উপস্থাপন করেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, তাহলে দুপক্ষের সমান সংখ্যক আইনজীবীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হোক।
তখন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষে ও খালেদা জিয়ার পক্ষে মোট ৩০ জন করে ৬০ জনকে আপিল বিভাগে প্রবেশের অনুমতি দেন। এ ছাড়া বাকি সবাইকে আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। এ জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেন প্রধান বিচারপতি। এরপর এজলাস থেকে নেমে যান পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। দুপক্ষের ৩০ জন করে ৬০ জন আইনজীবী থাকার পর এজলাসে প্রবেশ করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা টাকা জরিমানা করা হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে আরো তিন আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
রায়ের পর ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করেন খালেদা জিয়া।
ওই মামলায় গত ৩১ জুলাই হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন। এরপর গত ১৪ নভেম্বর সাতটি গ্রাউন্ডে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আপিল আবেদন করা হয়। ১৭ নভেম্বর আবেদনটি আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. নূরুজ্জামানের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ২৫ নভেম্বর শুনানির পর বিচারক সেটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতে তাঁর বিষয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। কিন্তু সেদিন প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় আদালত ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করে শুনানির জন্য আজকের দিন নির্ধারণ করেন।