জগমোহন ডালমিয়া
তিনি ‘টিনা’, বাংলাদেশের ক্রিকেট-বন্ধু
বন্ধু বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক পেয়েছে। ভবিষ্যতেও পাবে। তবে সেই বন্ধুদের তালিকায় একেবারে ওপরের দিকে থাকবেন তিনি। ওপরের দিকেই বা বলছি কেন, হয়তো ওপরেই থাকবেন। কারণ, তিনি ‘টিনা’!
অবাক হচ্ছেন, টিনা আবার কে? হতে পারেন। শব্দটা তৈরি ইংলিশদের। আর সেটা বেশি প্রচলিত ছিল সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে ঘিরে। তাঁর সম্পর্কে বলা হতো ‘দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ’, সংক্ষেপে টিনা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বন্ধু তালিকায় যাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, টিনা ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে তাঁর উত্তরণও মূলত থ্যাচারের সময়। আর ক্রিকেট-সাম্রাজ্যের শীর্ষ পদে তিনি বসেছিলেন গত সহস্রাব্দের শেষ দিকে। সাম্রাজ্য বিস্তারে রণকৌশল হিসেবে তিনি অবশ্য বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেটের বিশ্বায়নের স্লোগানকে। ইংলিশদের রক্ষণশীল মনোভাবের বিপরীতে আরেকটা স্রোত বইয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি। সেই বিপরীত স্রোতটাকে বেগবান করতে তাঁর দরকার ছিল একসময় ব্রিটিশশাসিত এশিয়া আর আফ্রিকান ক্রিকেট আবেগকে একীকরণ। এশিয়ান ক্রিকেটের শক্তিবর্ধন। তার জন্য দরকার ছিল ক্রিকেটে অর্থের। সেই অর্থের জোগানটা হতে পারে টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি থেকে। এবং এর সবকিছু তিনি করে দেখিয়েছিলেন। যে কারণে ক্রিকেটে একটা নতুন যুগের সূচনা। যেখানে ক্রিকেট খুঁজে পেয়েছে করপোরেটশাসিত দুনিয়াকেও। আর সেই লোকটার হাতে আঁকা অ্যারো মার্ক দেখে দেখে বাংলাদেশও খুঁজে পেল ক্রিকেটের এলিট ক্লাব। পেল টেস্ট স্ট্যাটাস। কিন্তু টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া আর টেস্ট খেলা এক নয়। মাঝখানের রাস্তাটাও বাংলাদেশের জন্য মসৃণ ছিল না। তাই সেখানে সবার আগে বাংলাদেশের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ছয় মাস পেরোনোর আগেই বাংলাদেশের মাটিতে টেস্ট খেলার জন্য পাঠালেন ভারতীয় দলকে। ক্রিকেট বিধাতার ইচ্ছা আর তাঁর সদিচ্ছায় ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ক্রিকেট গ্রহে প্রথমবারের মতো দুই বাঙালি টস করতে নামলেন কোনো টেস্টে! এর পর থেকে বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধা মেশানো কণ্ঠে বলে আসছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট-বন্ধু হিসেবে তাঁর কোনো বিকল্প নেই। দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ, তিনি টিনা। আর টিনা ক্রিকেট নামক মহান খেলাটার এক মহান সংগঠক—জগমোহন ডালমিয়া। এখন তিনি শুধুই ইতিহাস।
ইতিহাস থেকে বলতে পারি, জগমোহন ডালমিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বন্ধুত্বের সম্পর্ক শুরু একেবারে আশির দশকের গোড়ায়। সেই সম্পর্ককে দৃঢ় করতে প্রায় সব সময়ই অদৃশ্য এক সেতুর মতো কাজ করেছেন একজন—সৈয়দ আশরাফুল হক। বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে সংগঠক হিসেবে একসময় যিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সার্কিটে হয়ে উঠেছিলেন ‘বাংলাদেশের মুখ’! এবং সেটাও মূলত সেই জগমোহন ডালমিয়ার হাত ধরে। বাংলাদেশকে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যেত না, সে সময় ডালমিয়া যাকে ক্রিকেট-বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিতেন, ‘অ্যাশ আমার রাইট হ্যান্ড।’ আর লেফট হ্যান্ড ছিলেন অবশ্যই অবশ্যই আসিফ ইকবাল। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ডালমিয়াকে সংগঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন ওই দুজন। ডালমিয়ার অনেক উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা, সমর-মহাসমরের সাক্ষী এবং সৈনিক তাঁরা। ডালমিয়ার মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার মিনিট দশেক পর সৈয়দ আশরাফুল হককে ধরেছিলাম মোবাইলে। শোকাহত-বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত জগমোহন ডালমিয়ার অ্যাশ প্রথমেই বললেন, ‘কাল কলকাতায় যেতে চাই। কিন্তু আমার ইন্ডিয়ান ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। একদিনের ভেতর কি কোনোভাবে ভিসা করানো সম্ভব?’ ভিসা তিনি পেয়েছেন। কলকাতায়ও গেছেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় জগুদার দেহ ততক্ষণে কেওড়াতলার বৈদ্যুতিক চুল্লিতে পুড়ে শেষ। আর ডালমিয়া চলে গেছেন পাসপোর্ট-ভিসার বাইরে অন্য এক জগতে। জীবনের অন্যপ্রান্তের প্যাভিলিয়নে। চিরবিশ্রামে।
ডালমিয়াকে নিয়ে লিখতে বসে বারবার আসছে সৈয়দ আশরাফুল হক প্রসঙ্গ। তার অনেক কারণও আছে। ডালমিয়ার সঙ্গে এই লেখককে পরিচয়টাও করিয়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ অ্যাশ। আর বাংলাদেশ ক্রিকেটের বন্ধু ডালমিয়ার সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, উঠে এসেছে অ্যাশ প্রসঙ্গ। তাদের দুজনের সম্পর্কের মূল ভিতটা ছিল অবশ্যই বিশ্বাস। আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে একবার একটা অবিশ্বাসও তৈরি হয়েছিল। সে বিষয়ে পরে আসছি। তবে কাকতলীয় ব্যাপার হচ্ছে, জগমোহন ডালমিয়া শেষবার বাংলাদেশে এসেছিলেন বছর পাঁচেক আগে সৈয়দ আশরাফুল হকের মেয়ের বিয়েতে। কোনো ক্রিকেটীয় অনুষ্ঠানে নয়! যদিও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সেই অনুষ্ঠান রূপ নিয়েছিল ক্রিকেট মহলের একটা পুনর্মিলনীতে। সেখানেও ডালমিয়া বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট ঠিকই এগিয়ে যাবে।’ কথাটা যখন বলেছিলেন, তখন সত্তরে পা রেখেছেন ডালমিয়া। টেস্ট ক্রিকেটের আগের জমানার কথা মনে করে বলা যায়, ‘ডালমিয়ার জীবনে তখন ম্যান্ডেটরি ওভার শুরু হয়ে গেছে।’ আর বিধাতা যখন আঙুল তুলে জীবনের বাইশ গজে তাঁকে আউট ঘোষণা করলেন, তখন তাঁর নামের পাশে ৭৫। তবে জীবনের শেষ বছর তিনি দেখে গেছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট ঠিকই এগিয়ে চলেছে। তাঁর ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ড্র করেছে। ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুঃখ পেতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হয়েছিলেন।
ডালমিয়াকে বাংলাদেশের মানুষ যদি শুধু মনে রাখেন টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পেছনে তাঁর অবদানের জন্য, তাহলে একটু খাটো করেই দেখা হবে। রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিভাজন যতই থাকুক, তাতে কখনোই প্রভাবিত হননি ডালমিয়া। ক্রিকেটের স্বার্থে তিনি সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে ছিলেন। যখন যে পদেই তিনি থেকেছেন। বাংলাদেশকে যখন কেউ পাত্তা দেয়নি, সে সময়ও ডালমিয়া এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের যুগ্ম সম্পাদকের পদ দিয়েছিলেন আশরাফুল হককে! কারণ একটাই। বাংলাদেশ যাতে ক্রিকেট উন্নয়নে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে। বাংলাদেশের ক্রিকেট অবকাঠামো দুর্বল, অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলমান, আশির দশকের সে সময়েও ডালমিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশ পেয়ে যায় এশিয়া কাপ আয়োজনের দায়িত্ব। ওটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ওয়ানডে টুর্নামেন্ট আয়োজন। লক্ষ্য ছিল একটাই, বাংলাদেশ সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করুক। অবকাঠামোর উন্নয়ন করুক। ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উত্তাপটা আরো ভালো করে টের পাক। এবং অবশ্যই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে কিছু পয়সা আসুক। কারণ, পয়সা ছাড়া ক্রিকেট চলবে না, সেটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। ’৮৮ সালে বাংলাদেশ সফলভাবে এশিয়া কাপ আয়োজন করে প্রমাণ করেছিল, তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজনের দিক থেকে ব্যাক বেঞ্চার হতে পারে, তবে ফেল করাদের তালিকায় থাকবে না।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি যখন বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল, তখন তাদের ওয়ানডে স্ট্যাটাসের দাবিকে সমর্থন করেছিল ভারত। মানে সেই ডালমিয়া। এবং সেই সমর্থনের আওয়াজটাকে জোরালোভাবে ক্রিকেট-বিশ্বের কানে পৌঁছে দিতে পাশে টেনে নিলেন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকেও। বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাসও পেল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্নের একটা জবাব দেওয়ার সুযোগও করে দিলেন তিনি বাংলাদেশকে প্রথম ‘নকআউট বিশ্বকাপ’, এখন যেটা আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সেটা আয়োজনের দায়িত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এত বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনের সুযোগ এর আগে আসেনি। নয়টা টেস্ট প্লেয়িং দেশকে এক হোটেলে রেখে একটা মাঠে টুর্নামেন্ট আয়োজন ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে উতরে যাওয়ার আগে আরো একটা বড় চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের সামনে। ’৯৮-এর ভয়াবহ বন্যা। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের রিপোর্টে পূর্বাভাস দেওয়া হলো এক লাখ লোক মারা যাবে এই বন্যার প্রভাবে! ক্রিকেট-বিশ্বের নাক উঁচু এশিয়াবিরোধী লবি নড়েচড়ে বসল। কেউ কেউ বলতে শুরু করল, ঢাকায় কোনোভাবেই নকআউট টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া ঠিক হবে না! বাংলাদেশ সরকার, ক্রিকেট বোর্ড বারবার বলছিল, পরিস্থিতি মোটেও অত খারাপ নয়। সে রকম একটা অবস্থার মধ্যে জগমোহন ডালমিয়া সিএবিতে বসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ঢাকায় না হলে নকআউট বিশ্বকাপ ইডেনে হবে।’ কলকাতার গণমাধ্যমে খবর বের হলো, ‘নকআউট বিশ্বকাপ ইডেনেই হতে যাচ্ছে।’ ও রকম একটা খবরে তোলপাড় বাংলাদেশ ক্রিকেট মহল। কিন্তু ডালমিয়ার কাছে বিষয়টা সরাসরি জানতে চাইলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। এ রকম একটা শঙ্কা থেকে দুই বাংলার মিডিয়াকেই বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছিল সে সময়ের ক্রিকেট বোর্ড। রিপোর্টার হিসেবে তখন ছিলাম কাঠমান্ডুতে এসিসি ট্রফি কাভার করতে। সেখান থেকে কলকাতায় গিয়ে ডালমিয়ার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়। আজ স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, কলকাতায় ডালমিয়ার সঙ্গে প্রথম কথা বলার সুযোগটা করে দেওয়ার পেছনে ছিলেন সে সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাধারণ সম্পদক সৈয়দ আশরাফুল হক। ‘...আমি ডালমিয়া সাহেবের পিএস কুনালকে বলে দিয়েছি। ও কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবে।’ এবং কুনাল দিয়েছিলেন। ডালমিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল, আসলে ওই টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে ডালমিয়া কী করতে চাইছেন, সেটা পরিষ্কার না করায়। কলকাতা নয়, টুর্নামেন্টটা ঢাকাতেই হয়েছিল। কিন্তু তার আগে কলকাতার প্রভাবশালী পত্রিকায় প্রথম পাতায় শিরোণাম হয়েছিল, ‘কার স্বার্থে ওপারের টুর্নামেন্ট এপারে করতে চান ডালমিয়া,’ সেসব প্রতিবেদনে সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে পর্যন্ত উদ্ধৃত করা হয়েছিল। যাঁর ভাষ্য ছিল, ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় করতে আমরা যখন গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি করছি, সে সময় ঢাকার টুর্নামেন্ট কলকাতায় করলে দুটি দেশের সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। এই স্বার্থের প্রসঙ্গ নিয়ে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল—সিএবির প্রেসিডেন্টের রুমে বসে মিনিট ১৫ কথা হয়েছিল ডালমিয়ার সঙ্গে। টিপিক্যাল হাসি মুখে রেখে তিনি বার কয়েক বলেছিলেন, ‘আপনার প্রশ্ন যদি হয় কার স্বর্থের? তাহলে আমি বলব, আমার কাছে ক্রিকেটের স্বার্থটা সবার আগে।’ সে সময় কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক সত্যিই মাড়োয়ারি! কিন্তু তারপর নিরানব্বইয়ে ভারত-পাকিস্তান সিরিজ কাভার করতে গিয়ে আবার দেখা। সেই সিএবি অফিসেই কয়েকজন পাকিস্তানি বন্ধু সাংবাদিকের সঙ্গে আবার ডালমিয়ার সঙ্গে কথা। এবং সেই স্বার্থের প্রসঙ্গটা তুলতেই তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম ঢাকায় না হলে নকআউট বিশ্বকাপ ইডেনে হবে। কারণ, তার আগে অস্ট্রেলিয়া বলছিল, ঢাকার বিকল্প ভেন্যু মেলবোর্ন। সাউথ আফ্রিকা বলল জোহানেসবার্গ রেডি। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঢাকার জন্য অপেক্ষা করতে। তাই বলেছিলাম, ঢাকায় না হলে কলকাতায়। বিষয়টা মিডিয়াকেও আমি সে সময় খোলাসা করতে চাইনি। আমার পরিকল্পনা ছিল, যদি টুর্নামেন্ট সরিয়ে নিতে হয়, তাহলে শেষ মুহূর্তে সবচেয়ে নিকটবর্তী জায়গা কলকাতায় আনা যাবে। কিন্তু কোনো অজুহাতে যেন বাংলাদেশ থেকে টুর্নামেন্টটা সরে না যায়। সাবের-অ্যাশ মিলে যেভাবে টুর্নামেন্টটা শেষ করেছিল, সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।’ পরের অংশ তো ইতিহাস।সেই বাংলাদেশ টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি না হয়েও এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আয়োজক হতে পারল। না বললেও চলে সেটা সৌজন্যে জগমোহন ডালমিয়া।
সাংবাদিক হিসেবে ক্রিকেট সার্কিটের দু-একটা অলিগলি ঘোরার সুযোগে এত বছর পরে এসে বুঝতে পারি, ডালমিয়া ছিলেন এমন একজন সংগঠক, যিনি ক্রিকেট রাজনীতির বলটা বোলারের হাত থেকে বের হওয়ার আগেই পড়ে ফেলতে পারতেন। ঢাকার টুর্নামেন্ট কার স্বার্থে কলকাতায়, এ প্রশ্নের উত্তরে ডালমিয়ার নীরবতাই ছিল বাংলাদেশের স্বার্থে! ‘আসলে আমরাও ঠিক বুঝতে উঠতে পারছিলাম না জগুদা কেন ওই কথাটা বলেছিলেন। আবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়াটাও আমার জন্য ব্রিবতকর অবস্থা ছিল। পরে তিনি নিজেই বলেছিলেন।’ ওই ঘটনার প্রায় এক যুগ পর সৈয়দ আশরাফুল হক নিজের তেজকুনিপাড়ার বাসায় বসে লম্বা এক ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় বলেছিলেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ আজ শক্তিশালী। তার মূল কারণ টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি। আইসিসির অনুদান। এই দুটো বিষয়েই পরোক্ষভাবে জগমোহন ডালমিয়ার অবদান। শুধু বাংলাদেশের কথা বলছি কেন, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও যে আজ ক্রিকেট-বিশ্বে মাস্তানি করে টাকার জোরে, সেখানেও অবদান ডালমিয়ার। ক্রিকেটের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি নিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা প্রসার ভারতীর সঙ্গে মামলায় পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন ডালমিয়া। কিন্তু ছাড় দেননি। মামলা জিতে শেষ পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড টেল, স্টার-ইএসপিনের মতো সম্প্রচার সংস্থাকে ভারতে এনে খেলা সম্প্রচার করিয়েছেন। ক্রিকেটে অর্থ এনেছেন। কারণ, তিনি জানতেন গ্লোবাল স্পোর্ট হিসেবে ক্রিকেটকে টিকে থাকতে অর্থের দরকার। আবার খেলাটার বিশ্বায়নের জন্য অনুন্নত ক্রিকেট-বিশ্বকে তুলে আনতেও অর্থের দরকার। এটাও তিনি বুঝেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেট রাজনীতিতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের আধিপত্য খর্ব করতে হলে দরকার এশিয়া-আফ্রিকার ঐক্য। তাই আফ্রো-এশিয়া কাপ ছিল জগমোহন ডালমিয়ার ব্রেন চাইল্ড। এ রকম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষটাকে তাঁর নিজের দেশে অপমান-অসম্মানও করা হয়েছে! কিন্তু তিনি ডালমিয়া। জানতেন সম্মান কীভাবে পুনরুদ্ধার করতে হয়। তাই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নটআউট থেকেই চলে গেলেন।
তিনি চলে গেলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট কি খুঁজে পাবে তাঁর মতো কোনো বন্ধু? যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ মিস্টার ডালমিয়া, আপনি এ দেশের ক্রিকেট মহলে বেঁচে থাকবেন ‘টিনা’ হিসেবেই! আসল বন্ধুর কখনো মৃত্যু হয় না।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।