বিশ্ব শরণার্থী দিবস : আরও কঠিন হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
আজ ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। দীর্ঘ চার বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দুয়ার না খোলায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরা। বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরও রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের রাস্তা এখনও বন্ধই রয়েছে।
মিয়ানমারে গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া কিংবা বাংলাদেশে শরণার্থী জীবনযাপনে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে।
এদিকে, কোভিডের কারণে গত বছরের মতো এ বছরেও শরণার্থী দিবসের কোনো কর্মসূচি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পালন করা হচ্ছে না। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতাদের কাছে শরণার্থী দিবস উপলক্ষে কোনো সভা-সমাবেশ না করতে মৌখিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভারে ভারাক্রান্ত। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতন, জাতিগত নিধনযজ্ঞের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ক্র্যাকডাউনের পর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। তারও আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মিলিয়ে বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শরণার্থী ক্যাম্প বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ে অবস্থিত। ২০১৭ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় একটি চুক্তি হলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এবং তাদের নাগরিকত্ব মর্যাদাসহ কয়েকটি মৌলিক দাবি পূরণ না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো থমকে যায়। মিয়ানমারে গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা তরুণ যুবক কিংবা শিক্ষিতরা শরণার্থী জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগছে। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা তরুণী ও মানবাধিকারকর্মী শাহিদা উইন।
কক্সবাজারের উখিয়া শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা যুবক সুলতান মাহবুব মামুন জানালেন, নানা কারণে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনার কারণে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের লেখাপড়া বন্ধ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে বিভিন্ন অপকর্ম ও অপরাধের ঘটনা দিনদিন বাড়ছে। অন্যদিকে, প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তৃতীয় কোনো দেশেই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হোক।
রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ জানান, ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে যে বিচার চলছে, তার রায় হলে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর পথ সহজ হবে। তবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার, জাতিগত পরিচয় এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ দিলে রোহিঙ্গারা অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে যাবে।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকারের ওপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টি করতে রোহিঙ্গারা দাবি জানিয়েছে।
এদিকে উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কোনো একটি দেশে জন্মগ্রহণ করা নাগরিক আরেকটি দেশে নিগৃহীত হোক কিংবা শরণার্থী পরিচয়ে কবরে যাক, সে প্রত্যাশা করি না। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে স্থানান্তর কিংবা প্রত্যাবাসনের সঠিক উদ্যোগ এখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে না।’
শরণার্থী মুহিব্বুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের শরণার্থী জীবন শেষ হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু মিয়ানমারই এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী নিজেদের দেশে আমাদের অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে পারব। আগামী ২২ সালের শরণার্থী দিবসের আগেই আমাদের দাবি, আমাদের বিচার শেষ হলে আমরা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারব।’
শরণার্থী শিবিরে থাকা মামুন বলেন, ‘আমার জন্ম বাংলাদেশে। সেই ৯১ সালে আমার বাবা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। এখানে শরণার্থী ক্যাম্পে পড়ালেখা করেছি। শরণার্থী জীবন আর ভালো লাগে না। বাবার দেশে ফিরে যেতে চাই। আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকার। শরণার্থী শিবিরে নতুন প্রজন্ম নানা অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এখন করোনার কারণে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের নতুন প্রজন্ম বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমাদের বাবারাও আশা করে, তাদের সন্তানেরা রোহিঙ্গা জাতির জন্য কিছু করুক। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে।’
মামুন আরও বলেন, ‘আমরা আগে শরণার্থী দিবস পালন করতে পারলেও গত কয়েক বছর ধরে পারছি না। কারণ এখানে বেশিরভাগেরই শরণার্থী মর্যাদা নেই।’
এদিকে, সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা ইস্যু অন্তর্ভুক্ত না করায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। এ কারণে প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গত শুক্রবার মিয়ানমার বিষয়ে পাস হওয়া প্রস্তাবে দেশটির গণতান্ত্রিক সমস্যা, জরুরি অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আসিয়ানের কেন্দ্রীয় ভূমিকার প্রতি নজর দেওয়া হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা ও প্রত্যাবাসন বিষয়ে যথাযথ নজর দেওয়া হয়নি এবং কীভাবে এই সমস্যা সমাধান করা যাবে সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি। গতকাল শনিবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সে দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার এবং সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। ওই প্রস্তাবে ভোট দেয়নি বাংলাদেশ। ভোটদানে বিরত থাকার কারণ ব্যাখ্যায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এবং প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো পদক্ষেপের সুপারিশ না থাকায় বাংলাদেশ হতাশ হয়েছে।
এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা সাধারণ পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যা আশা করেছিলাম, এই প্রস্তাব তারচেয়ে কম এবং এই প্রস্তাব একটি ভুল বার্তা দেবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ব্যর্থ হয়, তবে মিয়ানমার কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করবে না।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর একটি কোর গ্রুপ মিয়ানমার-বিষয়ক প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। আসিয়ানের সদস্যদেশগুলো সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় মিয়ানমারের সামরিক নেতাসহ এক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিল। ওই সম্মেলনে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব সবাই মেনে নিয়েছিল, সেটিকে স্বাগত জানিয়ে বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে।
এ ছাড়া জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এবং জাতিসংঘের সব সদস্যদেশের প্রতি মিয়ানমারের কাচে অস্ত্র বিক্রি ঠেকাতে কাজ করতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
নিউইয়র্কে গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাস হওয়া প্রস্তাবের পক্ষে ১১৯টি ভোট পড়ে। বিপক্ষে ভোট দেয় শুধু বেলারুশ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান, লাওস, থাইল্যান্ড, রাশিয়াসহ ৩৬টি দেশ ভোট দেয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। তাদের ফেরত যাওয়ার জন্য রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার কথা এবং এই সমস্যা তৈরির মূল কারণের বিষয়েও কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এইব বিষয় বিবেচনা করে ভোটদানে বাংলাদেশ বিরত ছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, ওআইসি, আসিয়ান ও সার্কভুক্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশও ভোটদানে বিরত ছিল।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রস্তাবে সাধারণত দেশটির নিজের ভোট বিপক্ষে দেওয়ার কথা থাকলেও জাতিসংঘে দেশটির স্থায়ী প্রতিনিধি কাইউ মোয়ে তুন প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। মূলত তিনিই দেশটির সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন।
জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবে মিয়ানমারে গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিকদের মুক্তি দিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটি মিয়ানমার প্রত্যাখ্যান করেছে বলে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চ্যানেল নিউজএশিয়া জানিয়েছে। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবটি মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই এবং এই প্রস্তাব ‘একতরফা অভিযোগ ও ভুল ধারণার’ ভিত্তিতে করা হয়েছে।