এবার সত্যিই হারিয়ে গেলেন খায়তুন্নেছা
একটি ভাসা খবর পেলাম। পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের বারান্দায় এক বৃদ্ধা অবস্থান করছেন। তাঁর কোনো রোগ নেই। কোথায় তাঁর বাড়ি, কে তাঁর স্বজন; কিছুই জানতে পারছেন না কেউ। হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকারা আর্থিক সহযোগিতা করছেন এই বৃদ্ধাকে।
এমন তথ্য জানার পর এনটিভির পটুয়াখালী করেসপনডেন্ট কাজল বরণ দাসকে বললাম, খোঁজখবর নিয়ে ঘটনাটি জানতে। সতর্ক করলাম, বিষয়টি যেন কেউ না জানেন। দাদা জানালেন, হাসপাতালের বারান্দায় এক বয়স্ক নারীর বাস। কিন্তু, তাঁর পরিচয় জানে না কেউ। বৃদ্ধা কথা বলেন ভেঙে ভেঙে। পুরো বাক্য একসঙ্গে বলতে পারেন না। কিছুটা স্মৃতিভ্রমও আছে।
বিষয়টি অফিসের ঊর্ধ্বতনদের জানালাম। তখন আমার নিউজ সারা দেশে আলোচনার বিষয়। ‘২৩ বছর বিনা দোষে কারাগারে সিলেটের ফজলু’—এমন নিউজ করার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় চারদিকে। চিফ নিউজ এডিটর খায়রুল আনোয়ার এবং চিফ অব করেসপনডেন্ট জহিরুল আলম বললেন, ঘুরে এসো। দেখো, কী পাওয়া যায়। রওনা দিলাম পটুয়াখালীর উদ্দেশে।
২০১৫ সালের নভেম্বরের কোনো এক সন্ধ্যায় পৌঁছালাম পটুয়াখালীতে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানতে চাইলেন, কী নিয়ে কাজ করতে গিয়েছি। জানালাম, কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প নিয়ে কাজের কথা।
হাসপাতালে গেলাম ক্যামেরা ছাড়া। একজন সাহায্যকারী হিসেবে হায়াতুন্নেছার সঙ্গে কথা বললাম। কথা হলো ডাক্তার আতিকের সঙ্গে। যিনি এই বৃদ্ধার খোঁজখবর রাখেন, সহায়তা করেন। তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, গোছানো কিছুই পাচ্ছি না। তাঁকে খাবার খাওয়াই আর গল্প করি। একই কথা বার বার জিজ্ঞেস করি। কখনো আগের তথ্যের সঙ্গে মেলে, কখনো মেলে না। এভাবেই চলে যায় দুদিন। অনুসন্ধানের বিষয়টি জানাজানি হলে সমস্যা, নিজস্বতা হারাবে। এ ছাড়া হাসপাতালের বারান্দায় বৃদ্ধা, এটা একটি ছোট্ট নিউজ হতে পারে। উৎস সন্ধান হলে বড় নিউজ। এই বৃদ্ধার নামও জানা নেই হাসপাতালের তদারককারীদের কাছে। তাই তাঁরা নাম দিয়েছেন হায়াতুন্নেছা।
কয়েক বার জিজ্ঞেস করার পর বুঝতে পারলাম, ওই বৃদ্ধার নাম খায়তুন্নেছা। বাড়ি বলছেন, শরীয়তপুর। গ্রামের নাম আবছা বলতে পারতেন; বড় নাগা। ‘ও হাবি, হাবি’। বারবার এ নামটাই বলতেন। মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে এনটিভির শরীয়তপুর করেসপনডেন্ট আব্দুল আজিজ শিশির ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি খোঁজ নিয়ে জানালেন, ডামুড্যা উপজেলায় বড় নওগাঁ নামে একটি গ্রাম আছে। অনুরোধ করলাম, ওই গ্রামে যেতে এবং খোঁজ নিতে; হায়াতুন্নেছা অথবা খায়তুন্নেছা নামের কোনো বৃদ্ধা নারী হারিয়ে গেছেন কি না।
শিশির ভাই গেলেন, খোঁজ করলেন। কিন্তু, কোনো তথ্য পেলেন না। দিন শেষে ৪৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শীতের সন্ধ্যায় শহরে ফেরত আসলেন। ওনার মন খারাপ, আমিও হতাশ। পরের দিন সকালে জানালেন তাঁর জ্বর ১০৩ ডিগ্রি। আমি ও কাজলদা গেলাম কলাপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যে কমপ্লেক্স থেকে হায়াতুন্নেছাকে এক যুবক পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রেজিস্ট্রার খাতা ঘেঁটে কোনো তথ্য পেলাম না। শুধু একজন বলতে পারলেন, ওই এলাকায় একটি মেসে থাকা এক যুবক বৃদ্ধাকে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে সেখানে নিয়ে আসেন। অসুস্থ থাকায় বৃদ্ধাকে পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে রেফার করেন চিকিৎসক।
কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়ায় উৎকণ্ঠা আরও বাড়ল। মনে হলো, শূন্য হাতে ফিরতে হবে। চার দিন চলে গেল। কিন্তু, আলোর রেখা নেই। নিরুপায় হয়ে অসুস্থ শিশির ভাইকে আবারও বললাম ডামুড্যা যেতে। বলতেও মায়া লাগছিল। কিন্তু, কিছুই করার ছিল না। পরের দিন বিকেলে তিনি পুনরায় গেলেন। কোনো যোগসূত্র খুঁজে পেলেন না। সন্ধ্যা নেমে এলো। একটু পর পর শিশির ভাইকে ফোন দিচ্ছি। রাত বাড়তে থাকল, শঙ্কাও বাড়তে লাগল। সিদ্ধান্ত নিলাম, পরের দিন সকালে ঢাকায় ফিরব।
রাত ন’টার দিকে খাওয়ার মাঝে শিশির ভাই ফোন দিলেন। বললেন, ভাই একটু আশার আলো পাওয়া যাচ্ছে। উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম, কীভাবে! বলেন কী? শিশির বললেন, বড় নওগাঁ গ্রাম থেকে বের হওয়ার সময় জ্বরের তীব্রতা বাড়ছিল, শীতও লাগছিল। তাই পথের ধারে চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানি জানতে চাইলেন, দুদিন ধরে কী খুঁজছি? তিনি জানালেন, তাঁর চাচাতো ভাইয়ের শাশুড়ি কয়েক বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পরে এ ঘটনা ঘটে। এক ছেলে আছে, তিনিও চলে গেছেন পাকিস্তানে।
শিশিরকে বললাম, শাহের বানুর সঙ্গে কথা বলতে। বললাম, পুরো পরিবারের তথ্য নিতে। হাবি কে, এই বৃদ্ধার নাম কী এবং শিশির যে সাংবাদিক, এ পরিচয় না দেওয়ার জন্য। বলতে বললাম, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে গিয়েছেন কৃষকদের সহযোগিতার জন্য। হারিয়ে যাওয়া বৃদ্ধা সম্পর্কে কোনো তথ্য ওদের দিতে নিষেধ করলাম। শিশির বললেন, প্রত্যন্ত গ্রাম। কৃষক পরিবার। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। বললাম, চা-দোকানির সহযোগিতায় তাদের ডেকে ঘরে গিয়ে কথা বলতে। এত রাতে ডাকাডাকিতে ভয় পেয়েছিল ওরা।
ওখান থেকে বের হয়ে জ্বরের তীব্রতা আর শীতের কাঁপুনির মধ্যে শিশির জানালেন, ওই নারীর নাম খায়তুন্নেছা। হাবি হলো, ওনার ছেলের ঘরের নাতি। হাবিকে খুব স্নেহ করতেন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক বছরের মাথায় স্নেহের নাতি মারা যাওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন খায়তুন্নেছা। হঠাৎ বাড়িছাড়া হয়ে যান তিনি। বড় মেয়ের বয়সও ৬০ বছরের কাছাকাছি। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন, না পেয়ে ভেবেছেন মারা গেছেন খায়তুন্নেছা। সাত বছর হলো। তাই সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছেন। শিশিরকে বললাম, আপনি চলে আসুন।
কাজলদার সঙ্গে আলাপ করে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বললাম। জানালাম, তাদের হায়াতুন্নেছার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এনটিভি টিম হায়াতুন্নেছাকে তাঁর আসল ঠিকানা শরীয়তপুরে পৌঁছে দিতে চায়। পরের দিন সকালে জেলাপ্রশাসক ও সিভিল সার্জনের বক্তব্য ধারণ করি। কথা বলি হায়াতুন্নেছাকে যাঁরা সেবা দিয়ে পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন সেই চিকিৎসক আতিক ও সেবিকাদের সঙ্গে।
যখন বিদায় দেওয়া হলো হায়াতুন্নেছাকে, তখন সবার চোখ অশ্রুসিক্ত। গাড়ির বহর পটুয়াখালী পার হয়ে যখন বরিশাল পৌঁছায়, তখন ভরদুপুর। আমার বুকে ওঠানামা বাড়তে থাকে। আমরা যাঁকে নিয়ে যাচ্ছি, তিনি যদি খায়তুন্নেছা না হন! পরিবারের সদস্যরা তাঁকে যদি মেনে না নেন! এই বৃদ্ধার ভরণপোষণের সঙ্গতি যদি তাঁদের না থাকে? উনি যদি অন্য কেউ হন, তাহলে তাঁকে কোথায় রাখব, কী ব্যবস্থা করব? এমন নানান শঙ্কা মাথায় নিয়ে বরিশাল পার হয়ে মাদারীপুরের রাস্তা ধরলাম শরীয়তপুরের উদ্দেশে।
শরীয়তপুরের ডামুড্যা থেকে মাদারীপুর সোজা রাস্তা। মাদারীপুর শহর থেকে ঢাকা কিংবা বরিশাল যেতে হলে মস্তফাপুর আসতে হয়। শিশিরের সঙ্গে কথা বলে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করলাম, কীভাবে শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেন খায়তুন্নেচ্ছা। শিশিরের ধারণা, হয়তো খায়তুন্নেছাও এ পথই ধরেছিলেন। মস্তফাপুর এসে কুয়াকাটার বাসে উঠে পড়েছেন। বয়স্ক নারী দেখে হয়তো বাসের কর্মীরা প্রশ্ন না করে শেষ গন্তব্যে নিয়ে গেছে। এমনটি ধারণা করছেন খায়তুন্নেছার স্বজনেরা।
শরীয়তপুর শহর পার হয়ে আমাদের গাড়িবহর এগিয়ে চলল ডামুড্যার দিকে। খায়তুন্নেছার বাড়ির পাশে আগেই অবস্থান করছেন শিশির ভাই। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, আমাদের আশার খবর যেন কাউকে না জানানো হয়। সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে, তখন আমাদের গাড়ির বহর এগিয়ে চলেছে বড় নাগার দিকে। গাছের ফাঁক দিয়ে গলে পড়া সূর্যের আলোয় চিকচিক করছিল খায়তুন্নেছার মুখমণ্ডল। অ্যাম্বুলেন্সে বসে চারদিকের সবুজ প্রকৃতি দেখছিলেন। সঙ্গে থাকা সেবিকাদের বলছিলেন, এলাকাটি পরিচিত মনে হচ্ছে। তিনি যে বাড়ি ফিরছেন, সে কথা বলা হয়নি তাঁকে।
গোধূলী লগ্নে আমাদের গাড়িবহর পৌঁছাল খায়তুন্নেছার বাড়ির সামনে। রাস্তার ওপারে। কয়েকটি গাড়ি একসঙ্গে হঠাৎ থামতে দেখে অবাক হয়েছিলেন এলাকাবাসী। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছিল সবার। শিশির ভাই আমাকে ইশারায় বোঝালেন, রাস্তার পাশে পাতা ঝাড়ু দিতে গিয়ে অবাক বিস্ময় নিয়ে যিনি তাকিয়ে আছেন, তিনিই খায়তুন্নেছার মেয়ে শাহের বানু। বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। নেমে গিয়ে হাত ধরে তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে নিয়ে আসলাম। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করাতেই চিৎকার করে উঠলেন। মা! ও মা! এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য মাতিয়ে তুলল সবাইকে।
মা-মেয়ের মিলন হলো। একটু সময় দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি আপনার মা? চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু নেমে এলো তাঁর। খুশিতে ভরে উঠল আত্মীয়-স্বজনের মন। তাঁর মেয়ে শাহের বানু জানান, ভাতিজা হাবিবুর রহমান হাবি মারা যাওয়ার পরে শোকে পাথর হয়ে যান তাঁর মা। সারাক্ষণ নাতির নাম ধরে বিড়বিড় করতেন। হাবিকে খুঁজতে যেতেন।
শাহের বানু বলছিলেন, ‘মা নিখোঁজ হওয়ার পরে তাঁকে অনেক খুঁজেছি। হাবি মারা যাওয়ার পরে আমার ভাই গিয়াস উদ্দিন মাল ভাবিকে নিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। আমি পরের সংসার করি। মাকে বেশি দূর খুঁজতে যেতে পারিনি। শরীয়তপুর, মাদারীপুর খুঁজেছি। না পেয়ে ভেবেছি আর মনে হয় পাব না। বেঁচে থাকলে তো ফিরে আসতোই। আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজ এনটিভি আমার মাকে পৌঁছে দিয়ে গেল। মায়ের প্রথম জন্ম দেখিনি। মেয়ে হিসেবে দ্বিতীয় জন্ম দেখলাম।’
সবাইকে আনন্দে ভাসিয়ে বিদায় নিলাম পরিতৃপ্তি নিয়ে। এনটিভিতে দু-পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন সম্প্রচার হলো। শিশির ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখতেন। খায়তুন্নেছাকে সহযোগিতা করতেন। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্রাইম ওয়াচের কাজে শরীয়তপুর গিয়েছিলাম। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সময় করতে না পারায় দেখা করতে পারিনি।
স্বজনদের সান্নিধ্যে সাড়ে ছয় বছর কাটানোর পর গত রোববার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান খায়তুন্নেছা! সকালে শিশির ভাইয়ের ফোন পেয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। পটুয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকাদের হায়াতুন্নেছার হায়াত ফুরিয়ে গেল!
ওপারে ভালো থাকুন খায়তুন্নেসা। আপনার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : স্পেশাল করেসপন্টেন্ট, এনটিভি