সিআরবি আন্দোলন ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/09/09/crb.jpg)
চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতালের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন দুই মাস পার হয়ে গেল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনও কার্যকর সিদ্ধান্ত আমাদের চোখে পড়েনি।
বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে পরিবেশের বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। কোথাও বন্যা কোথাও ঘূর্ণিঝড় আবার কোথাও দাবানলে পুড়ছে বনভূমি। বন্যার কবলে পড়ে ভাঙনের কারণে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজারও কিলোমিটার ফসলি ভূমি ও বাড়িঘর। জলবায়ুর এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশেও। ছয় ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম বর্ষা আর শীত বাদে বাকিগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। প্রতি বছর ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল। সিডর আইলা মহাসেনের মতো ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত উপকূল। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের একমাত্র কারণ অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড। কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিতে পর্যাপ্ত গাছের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। চট্টগ্রামের সিআরবিতে শতবর্ষী গাছগুলো কাটার আয়োজন চলছে পরিবেশের এমন এক দুঃসময়ে।
সিআরবি শব্দের অর্থ হচ্ছে চট্টগ্রাম রেলওয়ে বিল্ডিং। ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন আসাম ও পূর্ব বাংলার রেলওয়ে সদর দপ্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলে সিআরবি। স্থাপত্যশৈলীমণ্ডিত কলোনিয়াল সেন্ট্রাল রেলওয়ের লাল রঙের ভবনটি বর্তমানে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। একাত্তরের ১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণার্থে স্মৃতিস্তম্ভ আছে এখানে। এ ছাড়া স্থানটি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের স্মৃতি।
জনাকীর্ণ এই ইট-পাথরের শহরে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে দিন দিন। এক কিলোমিটারের কম জায়গায় তৈরি হয়েছে শিশুপার্ক সার্কিট হাউস স্টেডিয়াম জাদুঘর পাঁচ তারকা হোটেল ও বিত্তবানদের জন্য ক্লাব। দুটি শপিং মল দুটি সিনেমা হল তিনটি কমিউনিটি সেন্টারও আছে এই অল্প জায়গার ভেতরেই। এম এ আজিজ স্টেডিয়াম ঘিরে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। এম এ আজিজ স্টেডিয়াম পার হয়ে সিআরবির শিরীষতলায় পৌঁছাতে পারলেই হাঁপ ছেড়ে কিছুটা বাতাস নেওয়া যায়। শান্ত কোলাহলহীন নিসর্গ শোভার সিআরবিতে আছে শতবর্ষী শিরীষ গাছ। এখানে রয়েছে দুর্লভ নানান পাখি ও প্রাণীর আবাস। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে পিচঢালা পাহাড়ি সাত রাস্তা। পাহাড় টিলা ও ছায়াঘেরা পরিবেশে নগরবাসীর প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণের স্থান এইটা। এখানে কেউ ব্যস্ত থাকে শরীরচর্চায় কেউ খেলাধুলায় কেউ বিনোদনে। পাশের শিরীষতলায় সারা বছরই চলে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হইহুল্লোড়ে সরগরম হয়ে ওঠে এই এলাকা। বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে জায়গাটি মানসিক প্রশান্তির।
এর মাঝে প্রাণের ফুসফুসখ্যাত সিআরবি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে পিপিপি একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছয় একর জমিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের চুক্তি করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে টাঙানো হয়েছে প্রকল্পের সাইনবোর্ড, ভেঙে ফেলা হচ্ছে রেলওয়ে কলোনির কর্মচারীদের থাকার জায়গা। প্রাকৃতিক আধার রক্ষায় হেঁয়ালিপনা দেখে ব্যথিত উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ হয়েছে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে নগরীর ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে। এ কারণে পয়লা বৈশাখ বসন্ত বরণ সাহাব উদ্দিনের বলিসহ নানান আয়োজন হয় শিরীষতলায়। মূলত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত কারণেও সাম্প্রতিক সময়ে সিআরবির গুরুত্ব বেড়েছে বহু গুণে।
এ ছাড়া প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় সিআরবিতে আছে ১৮৩টি ঔষধি গাছ। বিপন্ন প্রজাতির ৯টি উদ্ভিদসহ এখানে আছে ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হাওয়ার আশঙ্কায় থাকা ৭৫টি উদ্ভিদ। এলাকাটিতে বড় বৃক্ষ রয়েছে ৮৮টি, যার মধ্যে শতবর্ষী গর্জন ও শিরীষ গাছ অন্যতম। মোট কথা, জায়গাটি নিজেই একটি প্রাকৃতিক হাসপাতাল। এখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে শতবর্ষী এসব ঔষধি ও বিলুপ্তপ্রায় গাছের বেশির ভাগই ধ্বংস হয়ে যাবে চোখের সামনে। চট্টগ্রামের মাস্টারপ্ল্যানে সিআরবিকে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ কেউই হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নয়। কেবল প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্বের জন্য সিআরবিতে হাসপাতাল করা অনুচিত। চট্টগ্রামে চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি আছে, প্রয়োজন আছে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালের। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে না গিয়ে জনগণের স্বার্থে রেলওয়ে নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারলে সেটা আরও ভালো হয়। সিআরবি প্রতিষ্ঠার পর কাছাকাছি জায়গায় ছোট্ট একটি হাসপাতাল করে ব্রিটিশরা। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় কুমিরার রেলওয়ে যক্ষ্মা হাসপাতাল। নানান কারণে হাসপাতালটি বর্তমানে নিষ্ক্রিয়। রেলওয়ের প্রায় ৩৫ একর জমি পড়ে আছে সেখানে। কর্তৃপক্ষ চাইলে এ হাসপাতালকেই মেরামত ও আধুনিকায়ন করে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে পারে। চট্টগ্রামে রেলওয়ে অনেক জায়গার মালিক। উত্তর বা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্য কোথাও হাসপাতাল করলে বাধা নেই বা পরিবেশেরও বিপর্যয় ঘটবে না। তাই সিআরবি রক্ষায় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রত্যাশা চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের।
সিআরবি নিয়ে লেখাটি আমার ব্যক্তিগত। গত ১৩ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে আন্দোলন। সিআরবির বৃক্ষগুলোতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে ব্যানার অক্সিজেন সিলিন্ডার শো কাফনের কাপড় শো লাল কার্ড শো ভাষণ স্লোগান মিছিল মিটিং মতবিনিময় সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রীর কাছে দফায় দফায় স্মারকলিপি স্কুলশিশুর আবেগঘন চিঠিসহ আরও কত কিছু চলছেই প্রতিদিন। এতে কোনও ফল আসেনি, এটাই বিস্ময়কর।
লেখক : স্টাফ ক্যামেরাপারসন, এনটিভি, চট্টগ্রাম অফিস