গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
করোনাকালে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হলেও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির দিকে যাচ্ছে না সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে আশার কথা হলো, ১৯টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অবশ্য শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মনে শঙ্কা রয়েছে, এবার সাড়ে ১৩ লাখের বেশি পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করতে যাওয়ায় এত বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে পারবেন কি না! ইউজিসির হিসাব অনুযায়ী, ৪৬টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সরাসরি শিক্ষার্থী ভর্তি করা ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে ৬০ হাজারের মতো। বাকি আসন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেলসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে অনুমোদন পাওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৭টি। এ ছাড়া উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তির সুযোগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয় এমন কলেজ আছে ৮৬৭টি। এগুলোতে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তিযোগ্য আসন আছে চার লাখ ৩৬ হাজার ১৩৫টি। আর বিভিন্ন কলেজ মিলিয়ে স্নাতক পাস কোর্সে আসন আছে চার লাখ ২১ হাজার ৯৯টি। অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে আসন আছে আট লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি। এর সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য যোগ করলে উচ্চশিক্ষায় মোট আসন ১২ লাখের কাছাকাছি দাঁড়ায়। অথচ পাস করতে যাচ্ছে সাড়ে ১৩ লাখের বেশি।
অনেক হতাশা ও শঙ্কার মধ্যেও প্রত্যাশার কথা হলো, করোনা বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাংশ গুচ্ছ পদ্ধতিতে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণের চোখে অনেকটা উচ্ছ্বা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যান্য বছরের মতো এবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ফরম সংগ্রহ, জমা ও পরীক্ষায় অংশ নিতে ছাত্রছাত্রীদের দুর্ভোগ কিছুটা কমে আসবে। এ জন্যই হয়তো এই উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। গুচ্ছ প্রক্রিয়ার ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ছুটতে হবে না দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এমন প্রশান্তিতে নিশ্চিতভাবেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা নানা ঝুঁকি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবেন। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে নেওয়ার সিদ্ধান্তটিও বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হয়েছে। অন্যান্য বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় এখনো তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে শঙ্কা রয়ে গেছে।
প্রতি বছরই আমরা লক্ষ করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষার তারিখ বিভ্রাট হয়। একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। একই দিনে পরীক্ষা হওয়ার কারণে ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা দিতে পারে না অনেকে। অনেক সময় একই পরীক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, একটিতে ভর্তি হয়ে আবার ভর্তি বাতিল করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি বাতিল করতেও হাজার হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। বিগত কয়েক বছর আমরা লক্ষ করেছি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সর্বপ্রথম নেওয়ায় শিক্ষার্থী, ভর্তি ফরম ক্রয়, ভর্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভর্তি বাতিল করতেও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তাড়াহুড়ো করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দিক থেকে দুর্ভোগে ফেলে দেওয়া হয়। আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে, যাতে শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থ অপচয় না হয়।
বিভিন্ন কারণে আলাদা আলাদা পরীক্ষার বদলে কয়েকটি গুচ্ছ পরীক্ষা নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার বিষয়টির ন্যায্যতা সর্বমহলে প্রত্যাশিত। এতে অভিভাবকদের ব্যয় যেমন কমে যাবে, তেমনই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিতেও সুবিধা হবে। কোচিং বাণিজ্য কিছুটা হলেও কমে যাবে। সব মিলিয়ে নাগরিকদের মূল্যবান সময় এবং রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শিকার থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে। তবে এই গুচ্ছ প্রক্রিয়া সীমিত আকারে না করে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে কয়েকটি গুচ্ছতে আনতে পারলে অত্যন্ত মঙ্গলজনক হতো। দেরিতে হলেও গুচ্ছ পদ্ধতির এই যাত্রা আরো গঠনমূলক হোক, এটা আমাদের প্রত্যাশা।
সমন্বিত বা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতাও দূর করা যাবে। একটি মাত্র রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকায় এবং দূরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের প্রয়োজন না থাকায় শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি ও খরচ দুটোই অনেকাংশে কমবে। শুধু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক নয়, ঝক্কিঝামেলা কমবে বিশ্ববিদ্যালয়েরও। ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হয়। সমন্বিত পদ্ধতি চালু হলে মহাযজ্ঞ রূপ নিতে পারে সহজ একটি প্রক্রিয়ায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়