জীবনযোদ্ধা নারী
নারীর শ্রেষ্ঠত্ব মাতৃরূপে। যে মা লক্ষ বছর ধরে সন্তানেরে জগত চেনাচ্ছেন ঋষিতুল্য ধ্যানমগ্নতায়। আধ্যাত্মবাদে স্রষ্টাকে পাওয়ার নিমিত্তেই মুনিঋষির মহত্তম নির্বাণ লাভ হয়। তেমনি মায়ের মোক্ষ হলো নিজের উদরে ধারণ করে মনুষ্যের পরিব্যাপ্তি। জগত সংসারে নিবেদিত অনিবার্যতা তবু কেবলই মহাধারক মায়ের জন্য নয়।
মহা অভিজ্ঞান, সাহিত্য সম্ভার, বিশ্ব নীতিশাস্ত্র কিংবা ধর্ম দর্শন -সবখানেই আলাদা করে মায়ের বন্দনাগীতি গাইবার প্রয়াস পেয়েছেন পুরুষ, পিতা বা স্বামী। এই যে আলাদা করে দেওয়ার বিভাজিত চিন্তা তাই নারীকে সমান্তরাল মনুষ্যত্ব বোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
নারীর জন্য একটি বিশেষ দিন নির্বাচন করা সেই বিচ্ছিন্নতারই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ মাত্র।
পশ্চাৎপদ এই ভূমিতে নিজের সময়ের চেয়ে আগোয়ান নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শতবর্ষ আগে মায়ের অধিকারের কথা বলেছেন। নারীকে ঘুম ভাঙানিয়া গান শুনিয়েছেন।
অতঃপর তিনি আরও বলেন...
ভগিনীরা। চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন। মাথা ঠুকিয়া বলো মা। আমরা পশু নই; বলো ভগিনী। আমরা আসবাব নই; বলো কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বলো আমরা মানুষ।
সমকালে দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুলকেও মানুষের সাম্যবাদের পালে হাওয়া সঞ্চার করতে হয়েছে। নারী পুরুষের বিভাজন ভঞ্জন করতে মহাকালের সুবর্ণ পাতায় অমীয় অক্ষরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে লিখে রাখতে হলো...
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
তবু মানুষ কি আর নজরুলের কথা গায়ে মাখে?
পুরুষ কি আর মায়ের মর্যাদা দিতে জানে? মাতা ভগ্নি বধুকে শ্রেষ্ঠত্বের পরাকাষ্ঠায় সমাসীন করে?
আদি মাতা ও প্রথম বিদ্রোহী বলা হয় যিশু খ্রিস্ট জন্মেরও তিন হাজার বছরের আগের সুমেরীয় রূপকথার লিলিথকে। লিলিথ মানে রাত্রি। নারী নিষ্ক্রিয় তাই তার অভিধা অমানিশা। আর পুরুষ নিজেকে মনে করে সক্রিয় তাই তার তুলনা দিবালোকের দিবাকর।
অথচ লিলিথ ও তার সঙ্গী পুরুষটিকে স্রষ্টা এক মাটি থেকেই বিনির্মাণ করেছিলেন। পুরুষের আধিপত্য তিনি মানেননি বলে যুগ যুগান্তরে আগ্রাসী পিতৃতন্ত্র তার সেই নারী সত্তাকে শাস্তি দিয়ে চলেছে। পুরুষতন্ত্র জুজু হিসেবে রেখে দিয়েছে নিজেদের গড়া ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রকে। পুরুষ যেখানে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে যাচ্ছে, লিলিথ চেয়েছে শুধু মানুষের সমান অধিকার।
আব্রাহামিক ধর্মমতে এডামের সতীর্থ হিসেবে আদি নারী ইভের দেখা পাই। এডামের স্বর্গপতনের জন্যও পুরুষতন্ত্র ইভকেই দায়ী করে। দেখা যাচ্ছে পুরাণ থেকে অদ্যাবধি নারীর ওপর আরোপিত দোষারোপের ঘৃণ্য রাজনীতি থেকে পিতৃতন্ত্র বেরোতে পারেনি। যা কিছু ঘটুক রাবীন্দ্রিক কেষ্ট বেটা চোরের মতো নারীরই যত দোষ। পুরুষ তার বচনে, চলনে এবং শাস্ত্র প্রণয়নে নিজের দায়মুক্তি রেখে দিয়েছে সদর্পে সজ্ঞানে।
তাই তো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ওই একদের্শিক পৌরুষিক আধিপত্য রুখতে শক্ত হাতে কলম ধরতে হয় ...
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
নরক কুন্ড বলিয়া তোমা’ করে নারী হেয় জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর শয়তান।
জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহান।
পুরুষের ফাঁদ পাতা ভুবনে এত যে প্রতিকূলতা, তাই বলে নারীর বিপ্লব নির্বাপিত হয়নি। তার জীবনসংগ্রাম অজ্ঞেয় থাকেনি। তাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। বরং নারী কখনো কখনো পুরুষকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারপরও ঈর্ষাপরায়ণ পুরুষতান্ত্রিকতা এখনো সেই নারীর বন্দনাগীতি গাইতে জানে না। ঘৃণ্য নিন্দাবাদেই নারীকে পরাস্তের ফন্দিফিকির করে চলেছে। ইভ টিজিং কে রেখে দিয়েছে মনন ও মগজে। এতটা বাধাবিপত্তি পায়ে দলেও মাতৃরূপা নারী মানুষের বাগানে ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্কোচে।
তাই পৌরাণিক চরিত্র লিলিথ যেখানে নারী স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক। পুরুষের পরিচয় বহুগামী উড়নচণ্ডির বাইরে খুব বেশি কিছু নয়।
এখনো এই পোড়াভূমে নিশুতি রাতে গগনবিদারী মাইকে বেজে ওঠে মোল্লাতন্ত্রের ভয়াল চিৎকার। রাষ্ট্রযন্ত্রের আস্কারা ও নির্বিকারত্বে যেখানে নারীর প্রতি বিষোদগারকে নিয়ে যাওয়া যায় ধর্মীয় কারবারের প্রধান অনুষঙ্গে। নারীকে অবগুন্ঠিত করে ঘরের কোণে লুকিয়ে রাখবার পিতৃতান্ত্রিক আহাজারি চলে ধর্মের মোড়কে। বহুবিচিত্র নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে বন্দী করবার ফন্দিফিকির করে চলে নারী প্রগতিবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক কূপমন্ডুকেরা। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে বলে হায় কোথায় বেগম রোকেয়া, কোথায় বা রইলেন সাম্যবাদী কবি নজরুল।
তবু এই বাংলায় নারী চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট, ক্যাডার, ব্যারিস্টার, বৈমানিক, সৈনাধ্যক্ষ, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হচ্ছেন। নারী পুলিশ অতন্দ্র প্রহরায় দেশমাতৃকার নিরাপত্তায় রক্ষায় কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মতো নারীরা দীর্ঘদিন বাংলাদেশ শাসন করছেন।
করোনা অতিমারির কালে নারী নার্সদের অবিস্মরণীয় সেবার কথা ইতিহাস তো বটেই, মানুষের মণিকোঠায় স্থায়ী দাগ রেখে গেল নিশ্চয়ই। খাবারদাবার, ভোগ্যপণ্য, বসন, তৈজসপত্রসহ বহুবর্ণিল উদ্যোগে নিজেদের 'নিও নরমাল'-এ মানিয়ে নিয়েছেন হাজারো নারী উদ্যোক্তা। তাদের কর্মফলে গুণান্বিত হচ্ছে দেশ, জাতি ও মানুষ।
বাঙালি নারী এখন রীতিমতো গবেষণা করছে।
বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের তালিকায় ১০০ জনের মধ্যে আছেন বাঙালি নারী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা'র মতো প্রতিষ্ঠানে গবেষক ও বিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন সিলেটের মাহজাবীন হকের মতো নারীরা।
সেঁজুতি সাহার মতো মেধাবী নারীরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মনিটরিং বোর্ডে আধিকারিক হিসেবে যোগ দিয়ে নারীকে সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসবার প্রয়াসকে মহিমান্বিত করছে।
বিশ্বের বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতেও বাঙালি নারীরা তাদের যোগ্যতার সাক্ষর রাখছেন। ফেসবুকের বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মকর্তা সাবহানাজ রশিদ দিয়া এর অন্যতম উদাহরণ।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ফেরদৌস কাদরী এখন বিশ্ববিশ্রুত নাম। কলেরা নিয়ে গবেষণা এবং সাশ্রয়ী দামে টিকা সহজলভ্য করে রক্ষা করেছেন লাখো প্রাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে কাজ করছেন তিনি। যাকে নিয়ে বিল গেটসের মতো টেক জায়ান্টরা উচ্ছসিত প্রশংসা করেন।
কৃষি গবেষণায় যুগান্তকারী অবদান রাখায় বাংলাদেশে দুজন নারী বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ২০১৯ সালে। মাফরুহা আফরোজ ও মোসাম্মৎ শামসুন্নাহার নামের ওই দুই বিজ্ঞানী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁরা দুজন যথাক্রমে সবজির ঢলে পড়া রোগ দূর করার প্রযুক্তি ও মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ট্রাইকো কম্পোস্ট নামের একটি জৈব সার উদ্ভাবন করেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফুড ট্যাংক থেকে ওই বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ওই দুই বিজ্ঞানীসহ বিশ্বের চারটি দেশের আটজন বিজ্ঞানীকে এই অনন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই বছর এবং স্বাধীনতার মাস মার্চে আজকের নারী দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে সংবাদে এবং নাটকে দুইজন রূপান্তরিত নারীকে যুক্ত করল টেলিভিশন চ্যানেল বৈশাখী। রূপান্তরিত ওই নারীর নাম তাসনুভা আনান শিশির। অপরদিকে বিনোদন বিভাগের নিয়মিত নাটকের মূল চরিত্রগুলোর একটিতে যুক্ত করা হয়েছে আরেকজন রূপান্তরিত নারীকে। যার নাম নুসরাত মৌ। এতে মানুষের অগ্রযাত্রায় নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো।
এর বাইরে মাহমুদার মতো নারীদের হয়ত স্বজনের মুখে খাবারের সন্ধানে ক্লিষ্টকর পেশা বেছে নিতে হয়, ব্যাটারিরিকশার স্টিয়ারিং-এ ভরসা রাখতে হয়। লাখো নারীকে একশ্রেণীর মৌলভীদের কর্তৃক ব্যভিচারীর তকমা মাথায় নিয়েও স্বল্পবেতনে সকাল সন্ধ্যা পোশাক কারখানায় শ্রম বিলাতে হয়, হাজারো নারীকে ঘর গৃহস্থালির মতো দুর্বিষহ কর্ম করে যেতে হয়, ইটভাটার কালো ধোঁয়া গলাধঃকরণ করেও জীবিকার্জনে মনোনিবেশ করতে হয়।
তবু নারীর অগ্রগতিটাই বড়। পুরুষের কাধে কাধ মিলিয়ে সমান শক্তিতে কাজ করে তারা প্রমাণ করছে তাদের অধিকার সব মানুষের সমান নয় কেবল, বরং অনেক বেশি। কারণ তারা ঘর সংসার সন্তান সামলে তারপর রোজকার কাজে নামছে। মজুরি না হোক অন্তত সম্মান ও সমীহে নারী তাই আমাদের নমস্য।
নারীর প্রতি সহিংসতা, খুন, জখম, নিপীড়ন ও সম্ভ্রমহানির মতো ভয়াল লজ্জাকর বাস্তবতা পেছনে ফেলে চিন্তা, চেতনা, বোধ, বিবেক ও বিবেচনায় অতি অবশ্যই মানুষকে সভ্য ও প্রাগ্রসর হয়ে ওঠতে হবে। কে নারী কে পুরুষ আর কেই বা রূপান্তরিত তা বিবেচ্য নয়, মানুষের পরিচয় তার মহৎ কর্মে। এই অনিবার্য সত্য অবশেষে উচ্চারিত হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশার পালে এটাই দখিন হাওয়া।
সততা, সৌন্দর্যবোধ, উদারনৈতিকতা, সভ্যতা, মায়া, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ভালোবাসায় একদিন আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ হোক বিশ্বসেরা। আমাদের বিরামহীন কর্মনিষ্ঠা ও শ্রম তো তারই লাগি। উত্তরণের পথে সেদিন এই ভূমিতে নারীর জন্য একটি বিশেষ দিবসের জরুরত আর পড়বে না। সবদিনই সব মানুষের সমান সম্ভাবনার।
অমন এক সুবর্ণ দিনে নিশ্চয় কবি নজরুল অমর, অক্ষয় ও অবিনশ্বর থাকবেন...
পুরুষ-হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে অর্ধেক হৃদয় ঋণ।
লেখক : সাংবাদিক