বাজেট ২০২০-২১ : জীবন ও জীবিকা সমন্বয়ের প্রচেষ্টা
অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যতের পথপরিক্রমা সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। নজিরবিহীন করোনা পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত অজানার উদ্দেশ্যে অভিযাত্রার এরূপ বাজেট বাংলাদেশে ইতোপূর্বে কখনো দিতে হয়নি। অন্য বছরগুলোয় সাধ ও সাধ্যের দ্বন্দ্ব মেটানোর বাজেটের পরিবর্তে জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্ব মেটাতে অর্থমন্ত্রী এবার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৩% বেশি এবং জিডিপির প্রায় ১৮ শতাংশ। বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং ঘাটতি এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮.২%।
করোনাকালের স্থায়িত্ব ও রাজস্ব আদায় নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা এবং করোনার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে সুনির্দিষ্ট প্রাক্কলন না থাকা সত্ত্বেও এত বড় অঙ্কের বাজেট প্রদান করোনাযুদ্ধে সরকারের সাহসিকতা ও দৃঢ়প্রত্যয়কে প্রতিফলিত করে। বাজেটে প্রত্যাশামাফিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী এবং কৃষি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৩% বেশি। শিক্ষা খাতে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা বেশি। কৃষি খাতে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর জন্য ৯৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, যার মাধ্যমে এবার ১২ লাখ দুস্থ মানুষ নতুন করে সুবিধা পাবে। এ ছাড়া ১০০টি উপজেলায় এবার শতভাগ বয়স্ক-দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা হবে। করোনা মোকাবিলার জন্য বিশেষভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ এবং স্বাস্থ্যে উচ্চতর গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বস্তি পাবে। এ ছাড়া বিলাস দ্রব্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, শিল্পোৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে, পাচারকৃত অর্থের ওপর ৫০% কর আরোপ করা হয়েছে, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১% ক্যাশ ইনসেনটিভ দেওয়া হয়েছে এবং ওষুধের কাঁচামাল, মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি উৎপাদনের ওপর মূসক কমানো হয়েছে। এগুলো নিশ্চয়ই এবারের বাজেটের ভালো দিক।
তবে করোনা-পরিস্থিতিতে মানুষের প্রত্যাশা বিবেচনায় নিলে এবারের বাজেটে হতাশার চিত্রও ফুটে ওঠে। বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, কৃষি ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। এসব খাতে বাজেটের ব্যয় ব্যবস্থাপনার জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন ও উদ্ভাবনী উদ্যোগও নেই। পরিবহন খাতের ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়ে বরং এসব খাতের বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত ছিল। স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল এবং উপজেলা পর্যায়ের জনস্বাস্থ্য কাঠামোর উন্নয়ন জরুরি ছিল। কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিষেবা আরো বাড়ানোর দরকার ছিল। কিন্তু বাজেটে সে রকম উদ্যোগ নেই।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হলেও বাস্তব চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। করোনার অভিঘাতে অনেক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, যারা নিরাপত্তাবেষ্টনীতে পড়ে না, তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মাসিক হারে ৩ থেকে ৬ মাসের অর্থসহায়তা করার পরামর্শ দিয়েছিল বিভিন্ন মহল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। কৃষি খাতে ভর্তুকির মাধ্যমে দুই কোটি ১৩ হাজার ৫০০ কৃষককে উপকরণ সহায়তা দেওয়া হবে। তবে বর্গাচাষি, ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষি এবং আদিবাসী কৃষক এ বরাদ্দ থেকে তাদের হিস্যা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। বাজেটে ও বাজেট-পূর্ব প্রণোদনা প্যাকেজে ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো মাইক্রো, কুটির, ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (সিএমএসএমই), যেগুলোতে দেশের অকৃষি শ্রমিকের ৮৫% নিয়োজিত সেসব শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের চলতি পুঁজি ও উপকরণ-সহায়তার বিষয়ে বাজেটে আলাদা কিছু নেই। বিদেশফেরত অসহায় প্রবাসীদের সহায়তা প্রদানের দাবি থাকলেও তা বিবেচনায় আনা হয়নি। কালো টাকা সাদা করা বা বিনিয়োগ করার সুযোগদানের মতো অনৈতিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশে করোনার প্রভাব ও এর সময়সীমা সম্পর্কে যথাযথ প্রক্ষেপণ না করে ৮.২% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ সুচিন্তিত নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
লেখক : প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়