বিলুপ্তির পথে চট্টগ্রামের হালিশহর বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম বন্দরনগরী প্রাণ ও প্রকৃতির শহর। পুরো শহরের চারপাশ পাহাড়ঘেরা। এর মাঝে ক্রমশ বাণিজ্যের থাবা-আগ্রাসন। ইট-পাথরের বড় বড় দালানকোঠা সবদিক থেকে গ্রাস করছে নগরীকে। অনেক কিছু এখন প্রায় হারাতে বসেছে।
চট্টগ্রাম শহরের যেদিকে এখন চোখ যায় বড় বড় বিল্ডিং আর পিচঢালা সড়কের কারণে অনেক স্মৃতিচিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার চট্টগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বধ্যভূমি এখন ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে।
চট্টগ্রাম হালিশহর মধ্যম নাথপাড়া বধ্যভূমি আর পাহাড়তলী ফয়’স লেক বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিপরীতে বধ্যভূমি; দুটি বৃহৎ বধ্যভূমি। চট্টগ্রামে আরও অনেক বধ্যভূমি ছিল; কিন্তু এগুলো এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর মধ্যম নাথপাড়া বধ্যভূমিতে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে একাত্তরের মার্চের শেষ দিকে। পুরো নাথপাড়ার আশপাশ থেকে নরনারীদের এক জায়গা জড়ো করে একে একে সবাইকে রাইফেলের গুলিতে হত্যা করে আবার অনেকের দেহ টুকরো টুকরো করে উল্লাস করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য আর স্থানীয় বিহারিরা মিলে এই প্রলয়ংকরী ঘটনা ঘটিয়েছিল। গণচিতায় পুড়িয়েছে ৪৫ জনের ওপর নরনারীর লাশ।
শহীদ দীনেশ চন্দ্র নাথকে পাকিস্তানি সৈন্য আর বিহারিরা মিলে রাইফেলের গুলি দিয়ে ঝাঁজরা করার পর ছয় টুকরা করে অন্য লাশের সাথে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে এই বধ্যভূমিতে। ওই বধ্যভূমি এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। যে স্মৃতিফলকটি আছে, আর কয়েক বছর পরে তা-ও থাকবে না। যেটুকু আছে তার চারপাশে ঝোপঝাড়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। নেই কোনো সীমানা প্রাচীর। বধ্যভূমির আশেপাশে অনেক জায়গা প্রভাবশালীরা দখল করে বড় বড় বিল্ডিং করেছে। একই সাথে পিচঢালা সড়ক ও অবৈধ স্থাপনা তৈরি হয়েছে চারপাশে অনেক। সুরক্ষা না করলে আর কয়েক বছর পরে ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে হালিশহরের এই বধ্যভূমিটি।
হালিশহর মধ্যম নাথপাড়া ও আবুল পাড়া বধ্যভূমি শহীদবেদী অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে, যা সরেজমিনে না দেখলে বোঝা যাবে না। হালিশহরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়াবহ গণহত্যার শহীদ ৪৫ জন ব্যক্তির নামফলক রয়েছে ছোট একটি জায়গাতে। তাঁরা হলেন : শান্তিপদ নাথ, ডা. গৌর চন্দ্র নাথ, হেমন্ত কুমার নাথ, মানিক চন্দ্র নাথ, নারায়ন চন্দ্র নাথ, সুধাংশু চন্দ্র নাথ, শিউলী রানী দেবী মিনু, সুবল চন্দ্র নাথ, বনমালী নাথ, নরহরি বৈষ্ণব, রাধাগোবিন্দ নাথ, বাসুদেব বৈষ্ণব, ননীগোপাল নাথ, দীনেশ চন্দ্র নাথ, ক্ষিরোদ চন্দ্র নাথ, দুলাল চন্দ্র নাথ, বাদল চন্দ্র নাথ, মোহাম্মদ ইসহাক, বাবুল হক, আবুল খায়ের, ছিদ্দিক আহমেদ, রমনী মোহন নাথ, ব্রজেন্দ্র লাল সাহা, গণেশ চন্দ্র নাথ, ক্ষেত্র মোহন নাথ, হরি রঞ্জন নাথ, ধীরেন্দ্র চন্দ্র নাথ কবিরাজ, সুকোমল নাথ তপন, আলী সওদাগর, আবুল হাসেমসহ আরও অনেক শহীদের নাম রয়েছে এই বধ্যভূমির শহীদ বেদীতে। অযত্নে-অবহেলায় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে ঐতিহাসিক স্থানটি।
হালিশহর মধ্যম নাথপাড়া বধ্যভূমি গণহত্যায় শহীদ পরিবারের বেশ কিছু সদস্য এখনো বেঁচে আছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। তাঁরা প্রশ্ন করেন, আপনারা এখন নিজ চোখে দেখছেন না বধ্যভূমিটির কী অবস্থা? বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বহুবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।
তাঁরা জানান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এলে হালিশহরে যে একটি বধ্যভূমি আছে, তার জন্য বেশ কিছু মানুষ আর টিভি-পত্রিকার লোকজন এসে ফুল দেয়, বক্তব্য নেয়। অন্য সময় কেউ খোঁজও নেয় না।
সবশেষে বলবে, পাহাড়তলী ফয়’স লেক বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিপরীতে বধ্যভূমিটির অবস্থাও নাজুক। শহীদের রক্তে রঞ্জিত স্মৃতিচিহ্ন দুটি সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগ না নিলে বধ্যভূমি দুটি কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
লেখক : স্টাফ ক্যামেরাপারসন, এনটিভি, চট্টগ্রাম অফিস