সুবর্ণজয়ন্তীতে ধনধান্য পুষ্পভরা বাংলাদেশ
অনেকে বলেন চল্লিশ পেরোলেই চালশে, পঞ্চাশে বুড়ো। কিন্তু পঞ্চাশে যদি নিজেকে আঠারো ভাবা যায়, তাহলে ‘আঠারো বছর বয়সে’র অমর স্রষ্টা সুকান্ত ভট্টাচার্যই সত্যি হতে পারেন।
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
শৌর্য-বীর্য ও ঐশ্বর্যে আমরা যদি দেশটাকে চির যুবার আসনে বসিয়ে রাখি, তাতে তো মঙ্গল বৈ ক্ষতি নেই। মননে পঞ্চাশের প্রাজ্ঞতা আর কর্মনিষ্ঠা ও একাগ্রতায় যদি যৌবনের তীব্রতা ও প্রখরতা লালন করি, সেটা নিশ্চয়ই আমাদের সামনে চলবার পথকে রেললাইনের মতো সমান্তরাল ও মসৃণ করবে। আর আমরাও প্রাণখুলে যৌবনদীপ্ত কণ্ঠে গাইতে পারি...
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের মতো বহুবিচিত্র তন্ত্রমন্ত্র পেরিয়ে এসে আমরা এখন গণতন্ত্রের যে জায়গাটিতে এসে পৌঁছেছি, সেটাও নিরঙ্কুশ নিশ্ছিদ্র নয়। রাজনীতির ছিদ্র খুঁজলে নৈরাশ্যবাদী ছিদ্রান্বেষীরা বহু ফুটোই খুঁজে পাবেন। কিন্তু আমরা আশাবাদীরা বলব—গ্লাস অর্ধেক খালি নয়, অর্ধেক জলে পূর্ণ। সেই পূর্ণতাকে সারথি করেই আমাদের পঞ্চাশ হয়ে উঠবে দেশ ও দশের জন্য মঙ্গল সদাশয়।
এই সময় কবিগুরু রবিঠাকুর ঘনবরিষনে জলকলকলে আবার নিশ্চয়ই গেয়ে উঠতে পারেন—
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে।
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ—
কিছু নেতিবাচকতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের আর্থ-সামাজিক সূচক, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়ন, ফসল উৎপাদনের রেকর্ড, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, প্রবাসী শ্রমিকদের রেকর্ড রেমিট্যান্স, পোশাক শিল্পের প্রসার, মাতৃমৃত্যুর হার কমা ও শিশুদের টিকাদানে অগ্রগতি, বিদ্যুতে স্থিতাবস্থা এবং মন্দা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সাফল্য নিশ্চিতই আমাদের আগামীর পথের ভিত্তি গড়ে দেবে।
৩০ লাখ শহীদের অমূল্য প্রাণ, চার লাখ নারীর সম্ভ্রম এবং উদ্বাস্তু কোটি মানুষের দুঃখসাগর পাড়ি দিয়ে মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে বাংলাদেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল, তার নামটি এখন বিশ্বসভায় গর্বভরে উচ্চারিত।
দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন কর্মঠ ও দূরদর্শী নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন প্রাজ্ঞ নারী। নীতিনির্ধারণী রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছেন অনেক নারী। শিল্প-সাহিত্য, থিয়েটার, সংগীত, চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা ও সমরবিদ্যায় দারুণ পারঙ্গমতা দেখাচ্ছেন নারীরা। নারীরা যে পুরুষের সমান্তরালে থেকে তাঁদের কর্মনিপুণতায় পুরুষতান্ত্রিকতার অশুভ আর্গল ভেঙে ফেলতে পারে, বাংলাদেশ তার অনন্য নমুনা।
পঞ্চাশে এসে আমাদের চাওয়া-পাওয়া এখন একটাই, মানুষ যেন সর্বমানুষকে ভালোবেসে, সহমর্মী হয়ে সহাবস্থানে থাকে। আত্মত্যাগের মহিমায় বলীয়ান হয়।
জাতি ধর্ম গোত্র বর্ণভেদ যেন চিরতরে ঘুচে যায়। পুঁজিবাদী প্রভুত্ব ও নিষ্পেষিত দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে মানবিক সমাজ যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা না থাকি, আমাদের দেখানো আলোর পথ ধরে যেন উত্তরপ্রজন্ম সত্য ও সুপথের ঠিকানা খুঁজে পায়। এই ভূমির মানুষেরা আপন আপন ধর্মপথে থেকেও যেন রবীন্দ্র-নজরুল-লালন দর্শনে নিজেদের সুচিন্তার খোরাক পায়।
বলা হচ্ছে বর্তমান ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে, উনিশশো একচল্লিশে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নাম লেখাব আমরা। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা যদি সভ্য ও সুশৃঙ্খল না হতে পারি, কেবল অর্থনৈতিক সক্ষমতায় কোনোদিনই মর্যাদাশীল জাতিতে পরিণত হতে পারব না।
আমরা যদি স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে সংস্কৃতিবান মানুষ না হই, সমাজে কখনোই উদারনৈতিকতা ফিরবে না। বহুত্ববাদী জ্ঞানচর্চায় যদি আমরা উদ্দীপ্ত না হই, বিশ্বমানুষ হয়ে উঠবার সাধনা ফলপ্রসূ হবে না।
নারীশিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও সমানাধিকারকে যদি মন থেকে মেনে না নিই, নারীর প্রতি কাপুরুষোচিত সহিংসতা বন্ধ হবে না। দলদাসত্ব রহিত মুক্তমত যদি প্রতিষ্ঠিত না করা যায়, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন অর্থবহ হবে না।
আমরা চাই আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ সবখানে সবার আগে থাক। শিক্ষা, কর্মনিপুণতা, গবেষণা, উদ্ভাবন ও সেবায় বিশ্বসভায় নাম লেখাক।
বিজয়ের পঞ্চাশতম বর্ষে এসে হাতে হাত রেখে গলায় গলা মিলিয়ে মানবিকতার মালা গেঁথে সমস্বরে আমরা বাংলাদেশের সবাই আরেক বার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গেয়ে উঠি—
ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক—সকল দেশের সেরা;
লেখক : সাংবাদিক