১৫ আগস্ট, পিতা এবং শোকাবহ শূন্যতা
অশ্রুভেজা শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। আজকের সূর্যোদয় হয়েছে মহান নেতা জাতির পিতাকে স্মরণ করে। ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’, যে মানুষটির হাত ছুঁয়ে এসেছিল স্বাধীনতা, মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা, একটি দেশ।
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই মুজিব; কে বলেছে মুজিব নাই, মুজিব সারা বাংলায়; এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে—এই স্লোগানগুলো আমার রক্তের সাথে সতত প্রবহমান। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে মানুষটি থাকবে আমার প্রতিটি নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে। আমি কোনোদিন বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখিনি। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এই দুঃখবোধ যেমন আমাকে কাঁদায়, তেমনই মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু আমার প্রতিদিনের অহংকার।
আমার বাবার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাবার। আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু সেই গল্পগুলো কত বার যে শুনেছি বাবার মুখে। বঙ্গবন্ধু যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন, আমার বাবাও পড়তেন একই স্কুলে। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কয়েক বছরের ছোট। আমার বাবা প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। স্কুলে প্রথম বেঞ্চে বসতেন। কিন্তু কয়েক জন ছেলে প্রায়ই বাবার বইখাতা ফেলে পেছনে রেখে দিত। বাবা একদিন সেই সময়ের মুজিবকে এই বিষয়টি জানান। তার পর থেকে বাবা প্রতিদিনই প্রথম বেঞ্চে বসতেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে না দেখলেও এ রকম অনেক গল্পে বেড়ে উঠেছি বঙ্গবন্ধুর সাহস আর শক্তি নিয়ে। আমার বাবা আমাদের একটি লোহার তৈরি রড দেখাতেন আর বলতেন এটি নিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। সেই জনসভার গল্প আমরা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।
আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখনো বঙ্গবন্ধুর একটি পোস্টার আমাদের বাসায় টাঙানো দেখতাম। পঁচাত্তরের সেই দুঃসময়েও বাবা পোস্টারটি নামাতে দেননি। অনেক আত্মীয়-স্বজন এসে ভয় মাখানো কথা বলত। বাবা বলতেন, একবার তো একাত্তরে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি। সেই সময়ের দু-আনা দামের বঙ্গবন্ধুর সেই পোস্টারটি হৃদয়ের একেবারে গহিনে নিয়েই বড় হয়েছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু সেই সময়ের বিভীষিকাময় দিনগুলোয় আমার বাবা ভীষণ আহত হয়েছিলেন। তাঁর ভেতরের শূন্যতা এখনো অনুভব করি। শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে ঘাতকেরা... তিনি ভাবতে পারছিলেন না। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশেরই কিছু লোক তা ঘটিয়েছে... মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম... মুসলমানদের আহ্বান জানানো হচ্ছে। সে আহ্বান উপেক্ষা করে ঘাতকেরা এগিয়ে গেল ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত সব শহীদকে।
ঘাতকেরা ভেবেছিল, জাতির পিতাকে হত্যা করলেই তাঁর নাম মুছে ফেলা যাবে এই বাংলায়। কিন্তু তারা বোঝেনি বঙ্গবন্ধুর আরেক নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত যাত্রা থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছিল।
১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় দুর্যোগ নয়, এটি সারা বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। যে নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল, তার কোনো তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই। যখন এ দেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো একটি আইন ছিল, সেটি বাতিলের জন্য খুব বেশি মানুষের মিছিল দেখিনি। টক শোতে না হোক, আজকের দিনের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বদের কজনই বা ছিলেন এই কালো আইনের বিরোধিতা করবার জন্য। কিন্তু সেই সাদা কালো পোস্টারে যখন লেখা থাকত—কাঁদো বাঙালি কাঁদো... ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করো... সত্যিই বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদেছে বছরের পর বছর।
আমার বাবা যেমন বঙ্গবন্ধুর বীরত্বের কথা বলতেন আনন্দ নিয়ে আর আমরা সন্তানেরা শুনতাম সেইসব দিনের কথা। আমার বাবা কোনো নেতা ছিলেন না, সরকারের একেবারেই একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে জীবন পার করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু জীবনাচরণে ছিলেন সাহসী ও স্বাধীনচেতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করল ১৯৯৬ সালে, তখন বিটিভিতে বেশ কিছু অনুষ্ঠান করেছিল ১৯৭১ সালের নির্যাতিত মানুষের গল্প নিয়ে অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সেই সময় আমার বন্ধু আব্দুন নূর তুষার একটি অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেয়েছিল। তুষার আমার বাবার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল সেই সময়কে ধারণ করে। কিন্তু পরে জানতে পারি সেই সময়ের অনুষ্ঠানের কোনো কিছুই নেই আর্কাইভে। আমার কষ্ট হয়েছিল শুনে... সেটিই ছিল আমার বাবার মিডিয়াতে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার অথবা কথকতা। সেটিও তুষার বার বার অনুরোধ করায় বিটিভির স্টুডিয়োতে গিয়েছিল।
এ কথা মনে করার কারণ হলো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না, তখন অনেক বঙ্গবন্ধুর সৈনিককে দেখতাম যারা কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না করেই ৩২ নম্বরে ভিড় করত জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে অথবা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে এক নজর দেখতে। পরনে ময়লা কাপড় হয়তো, ‘নব্য আওয়ামী লীগারদের’ মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারত না, কিন্তু রিকশায় বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ শোনাত অবলীলায়। আমি সেইসব মুখ খুঁজে ফিরি। আমাকে এখনো উজ্জীবিত করে সেইসব দৃপ্ত শৃঙ্খলমুক্ত মুখ। পায়ে পায়ে যেন হারিয়ে না যায় সেইসব মুখ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর জীবনীকে অনুধাবন করতে হবে। এই দিনে আমরা এই মহামানবকে স্মরণ করি, শোকে কাতর হই, আবার শোককে শক্তিতে পরিণত করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব, মানবপ্রেম, অধিকারবোধ ও তাঁর নেতৃত্বগুণ, সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আপসহীনতার মতো গুণাবলি নিজেদের ভেতর ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, দেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে, সৎ কাজের মাধ্যমেই সম্ভব তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তোমার জন্য অতল শ্রদ্ধা হে পিতা।
লেখক : অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ এবং হল প্রোভোস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ