রাজনীতি
সংলাপ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সফল হোক
নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। মূলত বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো, এর আগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে দেশবাসীর সম্মুখে বিএনপিপ্রধান ১৩ দফার একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। গণমাধ্যমের খবর হলো, বিএনপির দাবিকে আমলে নিয়েই মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই সংলাপ প্রক্রিয়ার শুভসূচনা করলেন।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপিপ্রধানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদলের বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু ছিল একটি শক্তিশালী ও আস্থাশীল নির্বাচন কমিশন গঠন, যে কমিশন পরবর্তী সময়ে দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে। এর জন্য প্রয়োজন সার্চ কমিটি গঠনেরও। বিএনপি অবশ্য সার্চ কমিটি গঠনেরও একটি বুদ্ধিদীপ্ত প্রক্রিয়ার কথা তাদের প্রস্তাবনায় তুলে ধরেছে। প্রকৃত কথা হলো, একটি শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব অনেক, গণতন্ত্রকে টেকসই রূপ দেওয়ার পূর্বশর্ত হলো শক্তিশালী ও সৎ নির্বাচন কমিশন। তিক্ত হলেও সত্য যে, বর্তমান কমিশন কেবল গণতন্ত্রের জন্য দুর্যোগই বয়ে আনতে পারে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আমরা দেখেছি, সেখানে নির্বাচন কমিশন অপরিসীম শক্তি ও সাহস বজায় রেখে কাজ করে থাকে, বিশেষ কোনো প্রার্থী বা গোষ্ঠীকে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ তারা করে না। পৃথিবীর যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি স্বাধীন।
সাধারণ দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এই মহান বিজয়ের মাসে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে চলমান সংলাপ প্রক্রিয়াকে আমরা গণতন্ত্রের জন্য একটি ভালো পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে চাই। দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ যত বৈরীই হোক না কেন, এখানে আশাবাদী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই, কোনো ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য শুনতেও চাই না। পূর্বের অনেক সংলাপের অভিজ্ঞতা হয়তো খুব বেশি সুখকর নয়, তাই বলে এ কথা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে যে আগামী দিনেও কোনো সংলাপ সফল হবে না! বরং এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, অবশ্যই বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। বিএনপি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেই কথা বলার আগ্রহ দেখিয়েছে, রাষ্ট্রপতিও বিএনপিকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ডেকে অভিভাবকসুলভ ব্যবহার করেছেন। দেশবাসী এখন আশা করতেই পারে, ভালো কোনো খবর আসবে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে।
এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এ দেশে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো আইন তৈরি করা যায়নি। আমাদের দাবি থাকবে, সব বড় ও বৈধ রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে একটি টেকসই নির্বাচন কমিশন আইন তৈরি করার। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের চেয়ে বরং বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলে ভালো হতো। অবশ্যই এ কথা ঠিক যে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো বড় দুটি রাজনৈতিক বলয় যদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে, সে ক্ষেত্রে অনেক বড় সমস্যারই সহজ সমাধান সম্ভব। তবে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে চলমান এই সংলাপ সেই ঐকমত্যে পৌঁছানোর পথে অন্তরায় নয়, বরং রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি চাইলে সেই বৃহত্তর সংলাপের উদ্যোগও নিতে পারেন।
এ কথা মানতেই হবে যে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অবশ্যই সমঝোতায় পৌঁছতে হবে, গঠনমূলক বিরোধিতার বাইরে গিয়ে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার রাজনীতি দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যেহেতু দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে, সেহেতু তাদের অবশ্যই দেশের মানুষের স্বার্থের কথা আগে ভাবতে হবে, গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের কথা আগে আমলে নিতে হবে। দীর্ঘদিন দেশকে গণতন্ত্রবিহীন রেখে বহিঃশক্তির কুরুক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আগেই আমাদের নিজেদের মধ্যে ফায়সালা করার বিকল্প নেই।
সরকার এবং মাঠের প্রধান শক্তি বিএনপি যদি মনে করে, দেশের প্রয়োজনে আমরা একটি নৈতিক অবস্থান ঠিক করব এবং দেশের কথা বিবেচনায় নিয়ে কখনোই হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষই বেশি লাভবান হবে। কারণ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওপরই এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন আস্থা রেখেছে। এখন আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দল দুটি সমঝোতার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
লেখক : অধ্যাপক, বিভাগীয় সভাপতি, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।