নাসিক নির্বাচন
স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জয়
আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সঙ্গে সততা, সদিচ্ছা আর সক্রিয়তার মেলবন্ধনে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিএনপির বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য মেয়র আইভীকে অভিনন্দন। তিনি প্রায় ৬০% এর কিছু বেশি প্রদত্ত ভোটের মাঝে, বিএনপির ২৯% এর বিপরীতে ৪২% এর মতো ভোট পেয়েছেন। এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনগুলোর অন্যতম। এমনকি বিএনপিও এই নির্বাচনে অভিযোগ করার মতো কিছুই পায়নি।’
গণমাধ্যমে এই বিজয়কে বিচিত্র শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে। একটি লিখেছে, ‘শেখ হাসিনার নৌকার বিজয়’, অন্য একটি লিখেছে, ‘স্বস্তির ভোটে আইভীর বিপুল জয়’। ‘নারায়ণগঞ্জে নৌকার জয়’ শিরোনাম লিখেছে দৈনিক আমাদের সময়। অনলাইনগুলোও উচ্ছ্বসিত হয়েছে, লিখেছে ‘নৌকার হাল ধরে বিজয়ী আইভী’। আসলে জনপ্রিয়তার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী মোট ১৭৪ ভোট কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে এক লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের ধানের শীষ পেয়েছে ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদে নগরপিতা নির্বাচিত হয়েছেন ডা আইভী। তার উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকেই বেছে নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা। উপরন্তু শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। বিজয়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইভী বলেছেন, ‘এ বিজয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও সব মুক্তিযোদ্ধার নামে উৎসর্গ করলাম। যারা আমার বিজয়ে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের নিয়েই ভবিষ্যতে পথ চলতে চাই। একই সঙ্গে চাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে।’
২.
২২ ডিসেম্বর (২০১৬) নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন ও প্রার্থীদের প্রস্তুতি সর্বার্থে ভালোভাবে অগ্রসর হয়েছিল। সাতজন মেয়র পদপ্রার্থী বিভিন্ন দলীয় ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিল। নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডেই কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে সাখাওয়াতের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ডা. আইভী। আইভী বেশি পরিচিত এবং গত ১৩ বছর ধরে জনগণের কাছের মানুষ তিনি। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা মেয়র এবং পরে সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে স্বচ্ছ ইমেজের নেতা ডা. আইভী। দুর্নীতির অভিযোগ কিংবা ক্ষমতা অপব্যবহারের কোনো দৃষ্টান্ত নেই এই নেতার বিরুদ্ধে। জনগণ সম্পৃক্ত এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ডা. আইভীর অবস্থান। তাঁর পিতা নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত শ্রমিকনেতা আলী আহম্মদ চুনকাও ছিলেন সেখানকার একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এর আগের নির্বাচনে আইভী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীকে লক্ষাধিক ভোটে হারিয়েছিলেন। সব বিবেচনায় এবারও ডা. আইভী ভোট প্রাপ্তির বিচারে এগিয়ে জয়ী হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ‘ওসমান’ পরিবারের এমপি শামীম ওসমান তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। ২২ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মেরে ভোট দিয়েছেন। শামীম ওসমান জানতেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মান্য করেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে। এ কারণে তিনি নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে আইভীর পক্ষে কথা বলেছেন। আর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাতদিন নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করেছেন। সব মিলে আনন্দ-উল্লাসে প্রচার-প্রচারণা চলে। কারণ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পাশাপাশি আগামী সব নির্বাচনেই দলের বিজয় সুনিশ্চিত করতে তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির প্রভাবশালী নেতা তৈমূর আলম খন্দকার সেখানে যতটা পরিচিত সেই অর্থে মেয়র পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত হলেও বিএনপির নেতা হিসেবে ততটা গ্রহণযোগ্য নন। তাঁর ভরসা ছিল কেবল দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষ’। এজন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁর প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের ওপর বিএনপি এখনো ইতিবাচক রেখা অঙ্কন করতে পারেনি। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগের দিন আকস্মিকভাবে বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল। সেটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি তাদের নেতাকর্মীরা। এবার শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলেও জয়ী হতে পারে নি বিএনপি। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ১০ ডিসেম্বর (২০১৬) নারায়ণগঞ্জে সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষে ভোট চাইতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে আমরা বেছে নিয়েছি, এই নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করে জনগণের কাছে যাব। নারায়ণগঞ্জে সব মানুষ যারা গণতন্ত্র বিশ্বাস করে, যারা আইনের শাসন বিশ্বাস করে, যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা সবাই আজ একত্রিত হয়েছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অবশ্যই নারায়ণগঞ্জের মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং ধানের শীষের প্রার্থীকে জয়ী করবে।’ পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির এই আশা পূরণের অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের।
৩.
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সারা দেশে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তার আগে ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। আগামী ২৮ ডিসেম্বর ৬১টি জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র দুই মাস বাকি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কারণ বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের লক্ষ ছিল মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করা। তা ছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া মানুষকে আরো অনেক বেশি গণতান্ত্রিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করেছে। অর্থাৎ জনগণের ভোট নিশ্চিত করা হয়েছে যেন তারা যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নিতে পারে। ভবিষ্যৎ নির্বাচনের পরিবেশ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মতো হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়