রাজনীতি
সার্চ কমিটির এপিঠ ওপিঠ
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় বিগত প্রায় ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশনের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে এ কথা বলার কোনো উপায় নেই যে নির্বাচন কমিশন তার অস্তিত্ব জানান দিতে পারে। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছে অদ্যবধি কমবেশি তাই বহাল আছে। দলীয় সরকার হোক আর সামরিক সরকার হোক- বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন সাজানো হয়েছে। একটুখানি ব্যতিক্রম ২০০১ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ সাঈদ। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ অবশেষে বড় আশা করে নেত্রী তাঁকে নির্বাচন কমিশনার বানিয়েছিলেন। কিন্তু জিতে গেল বিরোধী পক্ষ। তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলা হলো। তিনি বললেন, ‘আমি নিরপেক্ষ নই, কিন্তু নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব।’
এ রকম পেশাজীবী মনোভাবের কর্তব্য পরায়ণ, নিষ্ঠাবান, মানুষ আজ কোথায়? বস্তুত বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা কোনো কালে কোনোক্রমেই নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্র করে আর্বতিত বা বিবর্তিত হয়নি। ক্ষমতাসীন সরকার সবসময়ই নির্বাচন ব্যবস্থার মূল কেন্দ্রে অবস্থান করেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে যদি একটি টেস্ট কেস হিসেবে ধরা হয় তাহলে আমরা দেখব-নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারকে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনেকবার জানিয়েছে। কিন্তু যত দিন পযর্ন্ত সরকার নির্বাচন কৌশল সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েছে তত দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করে। দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থাধীনে যে নির্বাচন কমিশন দেখা গেছে তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিশেষত পদ্ধতিগত কারণে মাথা উঁচু করতে পারেনি। নির্বাচন সর্বাংশে নিরপেক্ষ হয়নি। রাজনীতির উভয় পক্ষ ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ অথবা ‘স্থূল কারচুপি’র অভিযোগ উত্থাপন করেছে। ১৯৯১ সালে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেও যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়নি, তখন তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত সামরিক ও বেসামরিক আমলারা কলকাঠি নেড়ে তাদের পরাজিত করেন। তাই তারা এই প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন’ জোড়দার করে তোলে। পরে তারা দেখল এখানেও সমস্যা। তখন পঞ্চদশ সংশোধনীতে তাদের আন্দোলনে অর্জিত তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো। তারপর কীভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল- সেটি সবার জানা কথা।
বাংলাদেশে আবার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে দেখা যাবে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি ঘটবে। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন তার প্রমাণ। যাঁরা যুক্তি দেখান যে ২০১৪ সালে নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী শক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ‘জোয়ারে সব ভেসে যেত’ তাঁদের বলা যায় জোয়ার বাধাগ্রস্ত করবার জন্য অনেক বাধ দেওয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে একই কাজ করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তিনিও ইলেকশন কমিশন গঠনের আগে এ রকম সংলাপের আয়োজন করেছিলেন। প্রায় একই রকম কাঠামোতে ‘সার্চ কমিটি’ গঠন করেছিলেন তিনি। বিস্ময়ের ব্যাপার এবারের কমিটি প্রধান বিচারপতি মাহমুদ হোসেন ছিলেন সেই সার্চ কমিটিরও প্রধান।
দীর্ঘ সময় ধরে ৩১ রাজনৈতিক দলের সংঙ্গে সংলাপ করলেন প্রেসিডেন্ট। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে স্থায়ী আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিল। বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে বলেছিল। বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক প্রেসিডেন্টের পথটি আলঙ্কারিক– এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে হবে। তবে তিনি তাঁর রাষ্ট্রিক অভিভাবকত্ব দ্বারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। তবে তিনি প্রভাবিত করবেন কি না বা প্রভাবিত করার যোগ্যতা তাঁর আছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
যেহেতু নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সেহেতু রাজনৈতিক এলিটদের সম্মতিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তা বাস্তবানুগ হতো। এখন যেভাবে কমিটি গঠিত হয়েছে তাতে সবার প্রত্যাশা পূরণ হবে না। গতবারের সার্চ কমিটি থেকে এ কমিটির ভিন্নতা হলো এখানে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংযোজন। বলা হচ্ছে এঁদের আওয়ামী সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এত যে ঘটা করে সংলাপ অনুষ্ঠিত হলো তাদের কোনো সুপারিশই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাহলে সংলাপ শেষে সেই পুরনো আদলেই যদি কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এবং মনোনয়ন দেওয়া হলো সংলাপের কী প্রয়োজনীয়তা ছিল? শাসক আওয়ামী লীগ এবং অন্য যারা ক্ষমতাসীন ছিল তাদের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য এই যে আওয়ামী লীগ আইনের আবরণে নিজেদের ইচ্ছে পূরণ করতে জানে। আর অন্যরা সরাসরি ব্যবস্থা নিয়ে বা নিয়োগ দিয়ে ব্যর্থতা আড়াল করতে পারে না। দীর্ঘ সময় ধরে বিএপি ক্ষমতাসীন ছিল। তারাও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করেনি। সবাই যদি মূল চিকিৎসায় না গিয়ে মলম দিয়ে চালাতে চায় তাহলে এ জাতির ভবিষ্যৎ কোথায়? এখন বিএনপি নির্বাচন কমিশন নিয়ে কয়েক মাস ধরে কথাবার্তা বলছে। তাহলে কি তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দাবি থেকে সরে এসেছে? বিএনপি আগের বারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে সুদৃঢ় ছিল। পরবর্তী বাস্তবতায় তারা নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে। এই নির্বাচনকালীন সরকারই আসল কথা।
লেখক : কলামিষ্ট এবং প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়