অভিমত
এ কেমন ‘সমাজ’!
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ‘শাস্তির’ দাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রেখেছেন শিক্ষকরা। এমন খবর নিশ্চয় কারো জন্য সুখকর নয়। শিক্ষকরা সমস্ত একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের শাস্তি নিশ্চিত করবেন! আমাদের সমাজ কি এতটাই অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছে?
শিক্ষকদের বলা হয় সমাজের ‘বাতি’, যার আলোয় পুরো জগৎ হবে জ্যোতির্ময়। শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে সন্তানতুল্য। কিন্তু আজ সেই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া এ কিসের আলামত?
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতি গত রোববার তাদের সভায় ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের দাবি, ‘শিক্ষকদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছে শিক্ষার্থীরা। কথার অবাধ্য হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যসহ শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রাখে। এ ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের শাস্তি না হওয়া পযন্ত তারা ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া থেকে বিরত থাকবে।’ সেই সিদ্ধান্তে এখনো অটল আছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথম বর্ষের দুই সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষায় থাকে ৪০ ক্রেডিট। এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা ৩৩ ক্রেডিট পেলে পরবর্তী বছরে উত্তীর্ণ হতে পারে। এর কম পেলে শিক্ষার্থীকে ওই বর্ষেই থাকতে হয়। এই ক্রেডিট পদ্ধতির কারণে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের অন্তত ১৫০ জন শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে বলে গণমাধ্যমে খরব বেরিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা এই ক্রেডিট পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানিয়ে গত ২২ জানুয়ারি উপাচার্যের কাছে একটি লিখিত আবেদন করেছিল। সেখানে তিনদিন সময় বেধে দিয়েও কোনো ফল পায়নি শিক্ষার্থীরা।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কাজ না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ক্রেডিট পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামে। শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলের পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাধ্য হয়ে সেই পদ্ধতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এতে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন ‘অন্ধকার’ পথ থেকে বেঁচে যায়। যাতে শিক্ষকদের খুশি হওয়ারই কথা ছিল, যদি তাঁরা শিক্ষার্থীদের ‘সন্তান’ মনে করে থাকেন। কিন্তু বর্তমান চিত্র ঠিক তার উল্টো!
একইভাবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২২ জানুয়ারি থেকে টানা ১৯ দিন ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখেন শিক্ষরা। এই ১৯ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অন্তত ৩৩টি চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। ক্লাস হয়নি একটি বিভাগেও। আজ থেকে ক্লাস ও পরীক্ষায় ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষকরা।
একদিন ক্লাস বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয় তা কি শিক্ষকরা কখনো ভেবে দেখেছেন? গরিব ঘরের একটি সন্তানের শিক্ষাজীবন থেকে একটি দিন চলে যাওয়ার দাম কি শিক্ষকরা দিতে পারবেন? একদিন ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকলে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করবে কে?
শিক্ষকরা তো ঠিকই নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। পরিবারের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটাবেন। কিন্তু যে ছেলেটির বাবা অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বহন করছেন, তাঁর কাছে একদিনের মূল্য কত?
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা শূন্যের কোঠায়। তাঁদের ওপর শিক্ষকরা সব কিছু চাপিয়ে দেন। কোনো বিষয়েই শিক্ষর্থীরা তাঁদের মতামত তুলে ধরতে পারেন না। পরীক্ষায় নম্বরের ভয় দেখিয়ে ‘অসাধু’ শিক্ষকরা সব সময় শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষক সব সময়ই চান শিক্ষার্থীদের তাঁদের অধীনে রাখতে। নিজের অজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিতে। শিক্ষার্থীরা সব বুঝেও কিছু করতে পারেন না। কারণ তাঁদের সেই ইউনিটি বা প্লাটফর্ম নেই। যেমন শিক্ষকদের আছে। একদিকে নম্বরের ভয়, অপর দিকে শিক্ষকদের ইউনিটি। শিক্ষার্থীরা তাই বাধ্য হয়ে শিক্ষাকরা যা বলেন তা পালন করার ‘আপ্রাণ’ চেষ্টা করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষই একাডেমিক আলোচনা করার একমাত্র জায়গায়। যেখানে স্বাধীনভাবে জ্ঞানের চর্চা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হয়তো ঠিক তার উল্টো। সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গণে জ্ঞানের বদলে অন্য কিছুর চর্চাই বোধহয় বেশি হচ্ছে।
দীর্ঘ দিন ধরে এভাবে চলার কারণে স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন শুধু শিক্ষকদেরই ‘স্বায়ত্ত্বশাসন’ কায়েম আছে। যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন শিক্ষকরা। তাঁদের বেলায় কোনো আইন বা নিয়মের দরকার হয় না। তাদের ‘নীতিবোধ’ এখন হিমঘরে।
শিক্ষকরা ক্লাসে আসতে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করলে কিংবা না গেলেও কোনো অসুবিধা নেই। অনেক শিক্ষক এমন কাজ নিয়মিত করলেও শিক্ষার্থীরা তাঁর প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ তার নম্বরের ভয়! বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষককে দেখেছি, নিয়মিত তিনি দেরি করে ক্লাসে আসতেন, এমনকি অনেক দিন আসতেনই না। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যেতেন। কিন্তু ওই শিক্ষকের ক্লাসেই যদি কোনো শিক্ষার্থী পাঁচ মিনিট দেরি করে প্রবেশ করেন তাহলে...!
সমাজের এই অসমতা সব খানেই। এখন শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদের সন্তানের মতো দেখেন না, ঠিক তেমনিভাবে অনেক শিক্ষককেই আর ছাত্ররা সম্মান দেন না। অগোচরে শিক্ষকদের গালিও দেয় অনেক শিক্ষার্থী। যদিও সমাজের এমন চিত্র বেশ পুরোনো। জীবিকার টানে মানবতা, মানবিকতা কিংবা সম্মানবোধের ব্যাপারগুলো অনেকাংশেই সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে।
শুধু যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনটা হয়েছে তা নয়। সমাজের সব ক্ষেত্রেই এখন ক্ষমতাবানদের জয়গান। সমাজে এখন সর্বদাই চলছে অসততার চর্চা।
এমনটা চলতে থাকলে হয়তো আমাদের মতো ‘ছোটরা’ একদিন নীতিবোধ হয়তো ভুলেই যাব। তখন থাকবে শুধুই স্বার্থপরতা। ক্ষমতা কায়েকমই তখন হয়তো মুখ্য হয়ে যাবে সবার কাছে। সমাজের বড়রা যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে না ভাবেন তাহলে সর্বদায় ছড়িয়ে যাবে চরমপন্থা। যা সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। তখন সবাই শুধু প্রশ্ন তুলবে, এ কেমন ‘সমাজ’।
লেখক : সাংবাদিক