অভিমত
হেফাজত-ইসলামী ঐক্যজোট, সবই কি আ. লীগের দখলে যাচ্ছে?
হেফাজত কদিন ধরে বেশ হম্বিতম্বি করছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত কওমি মাদ্রাসা স্বীকৃতি পেয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা বৈঠক করেছে এবং হাইকোর্টের মূর্তি নিয়ে তাদের আপত্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও একমত পোষণ করেছেন। সবই সুসংবাদ তাদের জন্য। কিন্তু যেটা তারা বলছে না সেটা হলো, হেফাজতকে প্রায় ডেকে এনে সরকার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাব অস্বীকার করার সুযোগ ছিল এমনটা জানা যায় না।
কওমি মাদ্রাসা ব্যবস্থার স্বীকৃতি তারা অনেক দিন ধরেই চাইছিল কিন্তু কেউই তেমন পাত্তা দেয়নি। হঠাৎ করে এই এমএ ডিগ্রি লাভ কেন হলো এটা হেফাজতিদেরও অনেকের বোঝার বাইরে। হেফাজতিদের সঙ্গে সমঝোতাটা তাদের চাপে হয়নি, এটা আওয়ামী লীগের স্বার্থে এবং ইচ্ছায় হয়েছে। গোলযোগের মধ্যে এই কথাটা চাপা পড়ে গেছে। যেসব ইসলাম ও জামায়াতপন্থী নিজেদের রাজনীতির বিজয় দেখছেন এই ঘটনায় তাদের জন্য এটা সুসংবাদ নয়।
২. কওমি মাদ্রাসা ধর্ম শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে রুজি করা গোষ্ঠীর সবচেয়ে দুর্বল স্তর। কোনো জায়গায় তাদের চাকরি হয় না মসজিদ ছাড়া। কিন্তু যে সংখ্যক কওমি মাদ্রাসা থেকে পাস করে, সেই তুলনায় মসজিদে অত চাকরি নেই। ইদানীংকালের গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার ফলে মিলাদ-ওয়াজে রুজির ব্যবস্থা হয়েছে কিছুটা। কিন্তু হেফাজতিরাও সচেতন যে পেট চালাতে দুনিয়ার সহায়তা দরকার। এই কারণে তাদের সার্টিফিকেট প্রয়োজন, নিজেদের অর্থনীতিকে মজবুত করতে।
কিন্তু কওমি মাদ্রাসা কোনো একক ব্যবস্থা নয়, এটা নানা ভাগে বিভক্ত। এক নেতৃস্থানীয় লোক থাকলেও অনেক জেলায় একাধিক কওমি শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিযোগিতার বিষয়টা আসে অন্য মাদ্রাসার কাছ থেকে। কোনোভাবেই কওমি মাদ্রাসা একটা সংগঠিত শক্তি না। তাদের শক্তির মাপ বোঝা যায় ২০১৩ সালে ঢাকা থেকে বহিষ্কারের ঘটনাকে নিয়ে। গণমাধ্যমে সরকারবিরোধীরা বহু মানুষ হতাহত হওয়ার কথা বললেও হেফাজত এই ‘হত্যাকাণ্ডকে’ দাবিতে পরিণত করতে পারেনি বা করেনি। অতএব এই দুর্বল মাদ্রাসা ব্যবস্থার দিকে হাত বাড়িয়ে আওয়ামী লীগ কোনো শক্তিধর গোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করছে না, নিজেদের পছন্দমতো ‘মিত্র’ তৈরি করছে।
৩. এর পাশাপাশি রয়েছে জঙ্গিবাদ ঠেকানো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন যে কওমি মাদ্রাসায় কোনো জঙ্গি নেই, অতএব তারা নিরাপদ। চাকরি পেতে গেলে পুলিশের সার্টিফিকেট কারা পাবে সবার আগে এখন বোঝা যায়। সরকার যেমন নিয়মিতভাবে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালাতে থাকবে, ঠিক তেমনিভাবে উগ্রবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। এটা আদর্শের ব্যাপার না, এটা টিকে থাকার বিষয়। সেই সমীকরণে যদি ধর্মীয় নেটওয়ার্ক সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে তারই সুবিধা, হিসাবটা এখানেই। আওয়ামী লীগ বড় মাপের নিয়ন্ত্রণের পরিসর বাড়ানোর দিকে পা দিয়েছে পরিকল্পিতভাবে।
৪. বাকি থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা ও হাইকোর্টের মূর্তি সরানোর বিষয়। প্রথমটাকে হাসিনা সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন, অতএব ওটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আওয়ামী লীগ নিজে শোভাযাত্রা করেনি, সম্ভবত আর করবে না। কিন্তু কেউ করতে চাইলে পাহারা দেবে, আপত্তি করবে না। এই বিষয়ে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে ফেসবুকে আর টেলিভিশনে। কিন্তু সরকারের এতে কিছু এসে-যায় না।
হাইকোর্টের মূর্তিটি কমবেশি আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এসেছে। কারণ এর অপছন্দের কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন। অতএব যদি এটা সরানো হয় বা অন্য কোনো ব্যবস্থা হয় বোরকা পরানোসহ, তাতে খুব একটা রাজনৈতিক অসুবিধা আওয়ামী লীগের হবে না। সাধারণ মানুষের মনে এই মূর্তির পক্ষে সহানুভূতি নেই, তাই যে সিদ্ধান্তটি জনপ্রিয় সেটা সরকার করবে। একই সঙ্গে বিচারপতি সিনহাকে এর মাধ্যমে একটু চাপের মধ্যে রাখা হবে। সিনহা আমলাদের বিরুদ্ধে বহু গালি দিয়েছেন আর আমলানির্ভর বর্তমান সরকার তাঁকে পুরোপুরি ছেড়ে দেবে এটা ভাবা ঠিক না। তাই মূর্তি সরিয়ে সব দিকেই লাভ সরকারের।
৫. শেষ পর্যন্ত এসব খেলা আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণেই। হেফাজতকে সামনে এনে আওয়ামী লীগ একটি নতুন সামাজিক শক্তিকে সংগঠিত করছে নিজের হেফাজতে রেখে।
এই গোষ্ঠী তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে হলেও শেখ হাসিনাকে তারা মেনে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ইসলামী ঐক্যজোট ঢাকায় মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীরই কাছে আবেদন করছে মূর্তি সরানোর। হুমকি দিচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করার। কিন্তু সচিবালয় ঘেরাও করার তেমন কোনো উদ্যোগ তারা নিচ্ছে না। এরা সরকারের প্রতি কোনো হুমকি নয়, বরং তার আধিপত্য মেনে নিচ্ছে।
যাদেরকে সরকার হুমকি মনে করে, তারা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগ এদের উঠতে দেবে না, যতদিন পারবে যে কৌশলেই হোক। এই হেফাজত স্বীকৃতি আর মূর্তিবিরোধী আন্দোলনকে বাধা না দিয়ে আওয়ামী লীগ বোধহয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে আরো পুষ্ট হলো।
শেষ পর্যন্ত রাজনীতির খেলায় শেখ হাসিনা ও তাঁর দল অনেক এগিয়ে।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক