যোগে ব্যর্থ মোদি-রামদেব
(ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর তাঁর বন্ধু বাবা রামদেবের মতে দারুণ মিল। দুজনই আমিষবিরোধী, গো-মাংস নিষিদ্ধ করায় সমর্থন রয়েছে তাঁদের। একই সঙ্গে সমকামিতাকে তাঁরা মনে করেন একটি ‘রোগ’! বাবা রামদেব তো রীতিমতো সমকামিতার ব্যারাম সারাতে ‘ওষুধ’ বিক্রি করেন। এমনই সময় ‘ওয়ার্ল্ড ইয়োগা ডে’র মাধ্যমে গণমাধ্যমে দুর্দান্ত স্টান্ট দেখালেন মোদি। কিন্তু যোগের প্রকৃত লক্ষ্য কি মিলল তাঁদের? ‘ডেইলি ও’র অতিথি লেখক তেহসিন পুনাওয়ালার যাচাই অবলম্বনে মোদি-রামদেবের যোগ ও যোগাযোগ-সংক্রান্ত বিষয়-আশয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই লেখায়।)
জনপরিসরে কোনো কিছুকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে জুতসই ব্র্যান্ডিং খুব জরুরি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথা বলতে হয়। নিজের ব্র্যান্ডিং বা পণ্যায়নে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বন্ধু বাবা রামদেবকে পাশে নিয়ে নিজেকে ‘যোগব্যায়ামের চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে আসীন করতে সক্ষম হয়েছেন মোদি, যা ভারতের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের একটি।
পতঞ্জলির ‘যোগসূত্র’ বইটি দারুণ। পতঞ্জলি অনন্য, কারণ তাঁর বক্তব্য বিশুদ্ধভাবে বিজ্ঞানসম্মত। তিনি কখনোই আন্দাজের ওপর ভর দিয়ে কিছু বলেননি, আবার কোনো কিছু অস্বীকারও করেননি। পতঞ্জলি বলেছেন, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বহু রাস্তা রয়েছে, ঈশ্বর এগুলোর মধ্যে একটি। তবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ঈশ্বর কোনো বাধ্যতামূলক বা একমাত্র পথ নন। ঈশ্বর হলেন একটি উপায় মাত্র। কেউ এ পথ গ্রহণ করতে পারেন, কেউ অন্য কোনো পথ গ্রহণ করতে পারেন। পথ মুখ্য নয়, লক্ষ্যই মুখ্য। ঈশ্বর কেবল এই পথগুলোর একটি।
যোগব্যায়াম বা ইয়োগা হলো বিজ্ঞান—এটি আস্তিক্যবাদও নয়, নাস্তিক্যবাদও নয়। পতঞ্জলি কোনো ধর্মীয় প্রথা চালু করেননি, যোগব্যায়ামের অবস্থান এসব থেকে বহুদূরে। যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, যোগব্যায়াম হলো বিশুদ্ধ বিজ্ঞান। পতঞ্জলি কিন্তু এমনও বলেছেন যে, কোনো একজন মানুষ চাইলে ঈশ্বরের পথ অবলম্বন নাও করতে পারেন।
‘যোগসূত্র’ কখনোই নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্বের ওপরে জোর দেয়নি। পতঞ্জলি একে ব্যাখ্যা করেছেন ‘চিত্ত বৃদ্ধি নিরোধ’, যার অর্ধ হচ্ছে মনকে উদার করে দেওয়া, মনের জানালা খুলে দেওয়া। প্রকৃত সত্তায় পৌঁছানোই হলো যোগব্যায়ামের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে পক্ষপাতিত্ব এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
ভারতবর্ষের আরেক প্রাচীন ঐতিহ্য আয়ুর্বেদ বলে যে, মাংস এবং মাছ বিভিন্নভাবে রান্না করা যায়। আয়ুর্বেদের কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার যে, প্রকৃতিতে এবং জলবায়ুতে রয়েছে ভিন্নতা—তুষারাচ্ছন্ন অঞ্চল বা ধু ধু মরুভূমিতে যথেষ্ট পরিমাণ শাকসবজি থাকে না। যদিও মহাগুরু শিব হলেন যোগীদের সেরা, তিনি হিমালয়ের তুষার ছাওয়া কৈলাস পর্বতের চূড়ায় অবস্থান করতেন এবং তিনি ছিলেন নিরামিষভোজী! এমনকি তাঁর অনেক মন্দিরে নৈবেদ্য হিসেবে মদও দেওয়া হয়!
আমিষজাতীয় খাবারের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বন্ধু বাবা রামদেব দুজনই কথা বলে চলেছেন হরহামেশা। বিশেষ করে একটি আমিষ (গরুর মাংস) নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর মোদি উল্টো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো, এর সঙ্গে কি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো বা বিশুদ্ধতা অর্জনের কোনো সম্পর্ক রয়েছে? যোগব্যায়াম কিন্তু কখনোই এমন নিষেধের পক্ষে নয়। যোগসূত্র মূলত শেখায়, প্রকৃত সত্যে পৌঁছাতে হলে সমস্ত পক্ষপাত মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি পক্ষপাতের উদাহরণ, যেমন—আমিষজাতীয় খাদ্যের বিরোধিতা কিংবা সমকামিতার ওপর চড়াও হওয়া।
সমকামীদের ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বন্ধু বাবা রামদেবের নজর বিশেষ সুবিধের নয়। পতঞ্জলির নাম ব্যবহার করে বাবা রামদেব কী করেন—তিনি সমকামিতায় ‘অসুস্থ/আক্রান্ত’ লোকজনকে ‘সুস্থ’ করতে ‘ওষুধ’ বিক্রি করেন! তাঁর যেমনতর প্ল্যাটফর্ম, তাতে অনেকেই মনে করবেন এবং প্রভাবান্বিত হবেন এই ভেবে যে, ‘সমকামী হওয়া অশুদ্ধতাই বটে, নিশ্চয়ই এটা একটা রোগ!’ মজার বিষয় হচ্ছে, যোগব্যায়ামে কিন্তু অসুখ-বিসুখ বিষয়টার কোনো অস্তিত্বই নেই! যোগসূত্রে পতঞ্জলি লিখেছেন, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য ঐকতান সৃষ্টিই যোগব্যায়াম।
সুতরাং, প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, একই সঙ্গে সমকামিতাকে প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেও মেনে নিয়েছে। আজকের বিজ্ঞান এ বিষয়টা উদঘাটন করেছে যে, প্রকৃতিতে মানুষসহ বহু প্রাণীর মধ্যে সমকামিতা বিষয়টি রয়েছে। প্রাচীন ভারতে বিষয়টি কেবল মেনে নেওয়া হয়েছে তাই নয়, বরং রীতিমতো এর উদযাপনের নজিরও রয়েছে। ভগবান কৃষ্ণ ছিলেন আরেক শ্রেষ্ঠ যোগী। তিনি কিন্তু ‘মোহিনী’তে রূপান্তরিত হয়ে পুরো একটি রাত কাটিয়েছিলেন অর্জুনের পুত্রের সঙ্গে—যুদ্ধে জয়ের জন্য যাকে ‘উৎসর্গ’ করা দরকার পড়েছিল। অর্জুনের পুত্র কৌমার্য্য নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে চাননি, তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা! পরদিন সকালে ‘মোহিনী’ তাঁর স্বামীর জন্য শোক করেন এবং একজন বিধবার মতই ‘স্বামী’র জন্য বিলাপ করে ওঠেন। আবার ভগবান শিবের কথা বলা যায়, লীলা-নৃত্যের জন্য যিনি নিজেকে একজন ‘গোপী’তে রূপান্তর করেছিলেন।
ভারতীয় পুরাণে ভিন্নধারার যৌনতা বেছে নেওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ভারতের বহু সংস্কৃতিতে এই পছন্দকে রীতিমতো উদযাপনের গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কাজেই যখন প্রধানমন্ত্রী এই বিষয় নিশ্চিত করেন যে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান বা বাবা রামদেবের সঙ্গে ভারতও সমকামিতাকে ‘অসুখ’ হিসেবে সাব্যস্ত করবে, আবার বেশ কিছু খাবারকে ‘শুদ্ধতা’র বুলি আউড়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে—তখন এসব সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ডানপন্থী রাজনৈতিক আগ্রাসনই বলা যায়! এখানেই একটা বড় ধরনের সংশয় তৈরি হয়—তা হলো, এই ‘আসন’ আর ‘প্রাণায়াম’-এর মহড়া তাঁরা দারুণভাবে ব্র্যান্ডিং করতে পেরেছেন, তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। পক্ষপাত থেকে মুক্ত হতে না পারলে যোগব্যায়ামের মর্ম থাকে কি?