সাবাস বাংলাদেশ, দেখিয়ে দাও বিশ্বকে
‘বল বীর—/বল উন্নত মম শির।’
হ্যাঁ, বিশ্বের দ্বারে আজ আমাদের শির সত্যিই উঁচু। বাঙালি যে বীরের জাতি, তা আরেকবার প্রমাণ করল বাংলার একদল প্রাণোচ্ছল তরুণ। এ যেন যুদ্ধের ময়দানে সমূহ বিজয় জেনে একদল রাজপুত্রের দৃঢ়চেতা অবস্থান। একাত্তরে বুকের রক্তে যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল দামাল ছেলের দল, তারই সম্মান রক্ষা করল বাংলার টাইগাররা। ক্রিকেট বিশ্বে শক্তিশালী ভারত আজ পাকিস্তানের মতোই বাংলাওয়াশ হওয়ার অপেক্ষায়। আজ সাকিব, রুবেল, মুশফিক, মুস্তাফিজ কিংবা তাসকিনের দৃঢ় দৃপ্ত উজ্জ্বল মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তাঁদের মনের সংকল্প। তাঁরা যেন হরদম বলে যাচ্ছে—
‘আমি চির দুরন্ত দুর্দম।’
কোনো বাধাই আজ তাঁদের সংকট নয়, বরং সব ধরনের বাধা অতিক্রম করতে, মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আজ প্রস্তুত। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখত ক্রিকেট-বিশ্ব। দুর্বল দল হিসেবে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল আমাদের। কিন্তু আজ বাংলার বাঘরা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে তাঁদের সুদৃঢ় অবস্থান। আজ তাই বিশ্বকে বলার সময় এসেছে—
‘জাগিল তা’রা সকল/জেগে ওঠ হীনবল।
আমরা গড়িব নতুন করিয়া/ধুলায় তাজমহল।’
দ্বিতীয় দফায় ২১ জুন ভারতকে হারিয়ে ১৬ কোটি বাঙালির খুশির কান্না করেছিল বাংলাদেশ। যেন নজরুলের সেই বাণী আজ আমাদের ক্রিকেটারদের মুখেই মানায়—
‘মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে/ভরেছি মার শ্যাম আঁচল।’
ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশকে শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ক্রিকেটাররা। আমাদের সৌভাগ্য যে, বর্তমান বাংলাদেশ দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজ নিজ অবস্থানে অসাধারণ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট। তাঁদের খেলার গতিবিধি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, কীভাবে তাঁরা দলকে একটি দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রথমেই আসা যাক বোলিংয়ের কথায়। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে যে নামটি উঠে আসে, তা হলো মুস্তাফিজুর রহমান। মাত্র ১৯ বছর বয়সের এই বাঁহাতি পেসার যেভাবে খেলার শুরুটা করলেন, তা সত্যিই অবাক করার মতো। উপমহাদেশের মধ্যে ভারতের শক্তিশালী হওয়ার পেছনের কারণ হলো এখানকার ব্যাটিং সহায়ক পিচগুলো স্পিনারদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু ভারতের সেরা ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে দিলেন মুস্তাফিজ। পরপর ৬টি উইকেট হারিয়ে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হলো ভারত। তাঁর দুর্দান্ত বোলিংয়ের মাধ্যমে যেভাবে তিনি বিশ্বরেকর্ডে বিস্ময় সৃষ্টি করলেন, তা আমাদের জন্য গর্বের।
বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলেন মাশরাফি। শেন বন্ডের মতো তারকা খেলোয়াড়রা যেখানে ইনজুরির কারণে হারিয়ে গেলেন ক্রিকেট-বিশ্ব থেকে, সেখানে মাশরাফি দুই পায়ে অস্ত্রোপচারের পরও দুর্দম বেগে নিজেকে শতভাগ উজাড় করে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন সামনে থেকে। তাঁর কৌশলী নেতৃত্বেই বাংলাদেশ দল আজ বিশ্বসেরাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ দলের আরেকটি উজ্জ্বল নাম তাসকিন। অসাধারণ গতি ও বাউন্স তাঁর প্রধান হাতিয়ার। যার বলে তিনি ভাঙলেন বিরাট কোহলি ও শিখর ধাওয়ানের মতো শক্তিশালী ব্যাটিং মেরুদণ্ড। অধিনায়কের যখন খুবই প্রয়োজন উইকেট নেওয়া, তখনই তিনি খোঁজেন তাসকিনকে। বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানকে ভবিষ্যতে তাসকিনের বলে ধরাশায়ী হতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বকাপের পর থেকে যিনি নিজেকে অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তিনি হলেন রুবেল। তাঁর হাত ধরেই বলা চলে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। কোহলির সঙ্গে তাঁর দৈবরথ বিশ্বের ক্রিকেট মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়। বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার সাকিব বাংলাদেশ দলের গর্ব। তাঁর নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত বোলিং এবং গতির পরিবর্তন তাঁকে এনে দিয়েছে কৃপণ ও হিসাবি বোলার হিসেবে খ্যাতি। বিশ্বের যেকোনো পিচে যেখানে অন্য বোলাররা অসহায়, সেখানেও সাকিবকে হিসাবি বোলিং করতে দেখা যায় এবং প্রতি ম্যাচেই তিনি দলের জন্য এনে দেন মূল্যবান সব উইকেট। খেলার মাঠে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে খুব কম খেলোয়াড়ই। বাংলাদেশ দলে এর মর্যাদা দেওয়া যায় নাসিরকে। গত ম্যাচে নাসিরের বোলিংয়েই পাল্টে গিয়েছিল খেলার রং। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে একে একে ধরাশায়ী করলেন বিরাট কোহলি আর শিখর ধাওয়ানকে। স্পিন এক্সপার্ট ভারত নাসিরের স্পিনিংয়ে এভাবে হিমশিম খাবে, ভাবাই যায় না। শুধু বোলিংয়েই নয়, প্রয়োজনীয় রান অর্জনেও তিনি পারদর্শী; ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও নাসিরের ভূমিকা অসাধারণ। তার পর আসা যাক ব্যাটসম্যানদের কথায়। তামিম মানেই বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান। দারুণ সব শট, কাভার ড্রাইভ, ছক্কা, স্ট্রেইট ড্রাইভের মাধ্যমে মাঠ কাঁপান তিনি। তামিম আর সৌম্যের জুটির অপেক্ষায় যেন এতদিন ছিল বাংলাদেশ। এ দুই বাঁহাতির তাণ্ডবে কেঁপে ওঠে প্রতিপক্ষের বুক। শুধু তাঁরাই নন, বাংলাদেশ দলকে শক্তিশালী করতে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন লিটন ও সাব্বির। উত্তেজনাকর মুহূর্তেও দলকে কোনো প্রকার চাপের মুখে না ফেলে রানের গতি সচল রাখার কৃতিত্ব অর্জন করেন লিটন। আর দলের ৬ নম্বর খেলোয়াড় হিসেবে যে মারকুটে ব্যাটসম্যানের অপেক্ষায় এতদিন সবাই ছিল, তার স্থান পূরণ করেন সাব্বির। ‘মিস্টার হিটার’ নামটি তাঁর জন্যই প্রযোজ্য। ভারতের রাহুল দ্রাবিড়ের মতো বাংলাদেশও যেন তাঁর ‘মিস্টার ডিপেনডেবল’ পেয়ে গেছে। সে আর কেউ নন, অসাধারণ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান মুশফিক। তাঁর অসাধারণ ভূমিকা বাংলাদেশকে বিজয়ের আলো দেখিয়েছে খুব সহজে।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশ এখন কোনো দুর্বল দল নয়; বরং সব প্রতিকূলতা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে তারা। আমরা এখন ভারতকে বাংলাওয়াশ করার প্রতীক্ষায় সময় গুনছি। সে সময়টি দূরে নেই, যখন পৃথিবী অবাক তাকিয়ে থাকবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিশ্ববাসীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে—‘সাবাস বাংলাদেশ!’
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।