মুস্তাফিজদের হাত ধরেই হোক বাংলাওয়াশ
ঘড়িতে ভোর ৫টা বাজে। অ্যালার্ম বাজছে। শীতের সকাল। এই উঠি কি ওই উঠি ভাবতে ভাবতে বেজে গেল সাড়ে ৫টা। ছোট ভাইয়ের রুম থেকে ওর হাঁটাচলার শব্দ পাচ্ছি। ভাবলাম এত্তো সকালে কই যায় বাচ্চাটা? গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কই যাস ভাই?’ আমার ভাইটা কিছু বলার আগেই সেজো ভাই রুমে ঢুকে বলল, ‘কিরে কী করস তোরা? ছোটকু রেডি হস নাই? ৪০ কিলোমিটার যাইতে হবে। তাড়াতাড়ি রেডি হ।’ আমি বললাম, ‘আরে কই যাও ভাই?’ সেঝো ভাই বলল, ‘ছোটকুর প্র্যাকটিস আছে। ওরে দিয়া আসি।’ তখন আমিও বললাম, ‘তাড়াতাড়ি যাও, ৭টার মধ্যে তো মনে হয় পৌঁছাতে হবে।’ তখন ছোটকু বলল, ‘আপা আসি, দোয়া করিস।’ আমি ওর কথা শুনে হাসলাম। আমার সেজো ভাই বাইকের বুম বুম শব্দ করে ছোটকুকে নিয়ে চলে গেল। আর আমি ওদের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কতদূর যাবে আমার সহজ-সরল ছোট ভাইটি। ও তো শহরের কিছুই চেনে না। এখনো অবাক বিস্ময়ে ভাবছি কতদূর যাবে, কত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে রাস্তা পাড়ি দেবে আমার ছোট ভাইটি।এখন জানি, বিশ্বাসও করি ও অনেক দূর যাবে।
গল্প বলছি সাতক্ষীরা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে বসবাসরত এক পরিবারের। যেখানে সকালে রুটিন করে মুস্তাফিজ নামের একটি ছেলে রোজ সকালে ক্রিকেটের মাঠে অনুশীলনে যেত। তার সেজো ভাই মোখলেসুর রহমান রোজ তাকে বাইকে করে রেখে আসত। সকল চরিত্রই সত্যি শুধু একটি চরিত্রই কাল্পনিক। সেটি হচ্ছে গল্প বলিয়ে আমি অর্থাৎ বোনের চরিত্রটি।পাঠকের কাছে একটু হয়তো আদিখ্যেতাই মনে হচ্ছে। হোক না একটু আদিখ্যেতা। মুস্তাফিজ না হয় আমার কল্পনার ছোট্ট ভাইটিই হলো। জীবনে খুব কম সময় আমার মনে হয়েছে একটি ভাই থাকলে ভালোই হতো।
এই অসাধারণ একটি নক্ষত্রের অতি সাধারণ হয়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকার প্রবণতা সারা বাংলাদেশকে মুগ্ধ করেছে, আমাকেও। একটি টিনটিনে পাতলা উনিশ বছর বয়সী তরুণের চৌকস ও সুদক্ষ খেলায় কুপোকাত হয়েছে নামকরা ক্রিকেট তারকা। এ পৃথিবী দেখছে অবাক বিস্ময়ে, দেখছে বাংলাদেশকে, জ্বলজ্বল করছে ক্রিকেট অঙ্গনে।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্রিকেটমাতালরা। যারা হয়তো সারা দিন ক্রিকেটামি করছে। পড়তে বসলেও তাদের অবচেতন মন বল করছে, ছক্কা মারছে, ক্যাচ ধরছে। অথবা হঠাৎ করেই তাদের বল ভেঙে ফেলছে প্রতিবেশীর কাচের জানালা। আমরা কি সেই কিশোর কিশোরীকে চিনতে চেষ্টা করেছি কখনো? বরং পড়া বাদ দিয়ে একটু খেলা করলেই কান ধরে বসিয়ে দিয়েছি পড়তে। কখনো হয়তো বুঝিনি তার অবচেতন মনের ছক্কা মারার উচ্ছাস, উইকেট নেওয়ার উদ্দীপনা। যদি সেটা করতে পারতাম তাহলে বাংলাদেশের ক্রিকেট জগতে এ ধরনের আরো দু-একজন বিস্ময়ের হয়তো দেখা মিলহত।
কিছুদিন আগে একজন ছাত্র এসে জিজ্ঞেস করছিল, আমায় কীভাবে ক্যারিয়ার প্লানিং করবে। আমার একটাই উত্তর ছিল, তুমি যেটাতে ভালো সেটা করবে সেটা হতে পারে সরকারি চাকরি, বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা অথবা অন্য যা কিছু করতে তুমি পছন্দ করো। এই নিজের স্ট্রং পয়েন্টটা জানতে বা পরিবারকে জানাতে হয়তো আমাদের অনেক বেশি বেগ পেতে হয়। মুস্তাফিজ অনেক ভাগ্যবান যে তার পুরো পরিবারের সবাই সেটা জানে এবং তাকে সে সুযোগটা করে দিয়েছে। আর এ জন্যই আজকের মুস্তাফিজ আকাশে উড়ছে, সবার সামনে তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে যাচ্ছে বিজয়ের ঝান্ডা ।
এই সহজ-সরল ছেলেটি জানে কীভাবে ক্ষিপ্ত বাঘের মতো ছিনিয়ে নিতে হয় উইকেট আবার কীভাবে দলের বড় ভাই মাশরাফির কাছে ছোট্ট বিড়ালের ছানা হয়ে আদায় করে নিতে হয় আদর অথবা আশ্রয়। সে স্বভাবগতভাবেই লাজুক। সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, লজ্জা পেয়ে একটু হাসা বা ঠোঁট কামড়ে ভাবতে ভাবতে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, নির্দ্বিধায় নিজের দোষ স্বীকার করে নেওয়া, কোনো কিছু বলতে সমস্যা মনে হলে মাশরাফি ভাইকে বলে ফেলা, ‘ভাই আপনিই বলেন।’ অথবা সাংবাদিকদের প্রশ্নে তার সহজ স্বীকারোক্তি যে সে সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখে এবং ঘুম ভালো হলেই ভালো খেলতে পারে- সবই এই নিষ্পাপ ছেলেটির বৈশিষ্ট্য। কে হতে চাইবে না এই সরল কিন্তু বিস্ময়কর ছেলেটির ভাই? আর এ ছোট ভাইটির দিকে আজ তাকিয়ে পুরো বাংলাদেশ! এই লাজুক ছেলেটির বোলিংয়ের মূল অস্ত্র গতি নয়, বরং তা হচ্ছে সুয়িং, স্লোয়ার ও কাটার। ও এলো, দেখল, জয় করল, একের পর এক রেকর্ডের খাতায় নাম লেখাল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফির মতে, ‘কাটার বলে খেলা খুবই কঠিন। যা এই ধরনের উইকেটে খুবই উপযোগী। ওর বলে ভ্যারিয়েশন আছে । ওর উপরে আগে থেকেই কনফিডেন্ট ছিলাম। এ জন্য মুস্তাফিজকে আগে থেকেই টার্গেট করা হয়েছিল।’ মাশরাফি নিজে প্রথমে বল না করে মুস্তাফিজকে দেওয়ায় ও খুশি হয় এবং সেটাও সে সরল মনে প্রেস কনফারেন্সে সরল ভাষায়ই বলে ফেলে। মধুর ক্যান্টিনের চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে ফেসবুকের ওয়াল অথবা পত্রিকার প্রচ্ছদ- কোথায় নেই এই ক্রিকেট বিস্ময়? সর্বত্র তাকে নিয়ে আলোচনা।
যে হালকা-পাতলা ছেলেটিকে ভারতের অধিনায়ক ধোনি ধাক্কা মেরেছিল, তার ধাক্কার টাল সামলাতে টলমল আজ তাদের অবস্থান। মুস্তাফিজ আমাদের অহংকার নয়, গর্ব। আজ প্রতিশোধ নয়, অস্তিত্বের লড়াই। ষোল-সতেরো কোটি বাঙালি আজ চেয়ে আছে মুস্তাফিজ, সাকিব, তামিম, তাসকিন, মুশফিক, নাসির, সাব্বির, রুবেল, সৌম্য, লিটন, মমিনুল, মাশরাফির মতো টাইগারদের দিকে । গত বিশ্বকাপে আমাদের অযাচিতভাবে বাদ পড়ার দুঃখ আজ যদি মেটে। আজ যদি আমরা সেদিনের হৃদয়বিদারী কষ্টের উচিত উত্তরটুকু দিতে পারি ।
হ্যাঁ আমরা খেটে খাওয়া কৃষকের জাত, আমরা ছেঁড়া জামাকাপড় পরি, আমরা দিন আনি দিন খাই, নিম্নবিত্তের জীবন ধারণ করি, তবু গর্ব করে আমরাই বলতে পারি আমরা বাঙালি । মুস্তাফিজ, যে ছেলেটি সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, কথায় কথায় ইংরেজি হয়তো সে বলে না, সে এতটাই ছোট যে এখনো জানে না কী করে গুছিয়ে কথা বলতে হয় । কিন্তু সে তার প্রত্যয়ে অটুট। তাই তো সে তার প্রেস কনফারেন্সে বলে, ‘ম্যাচ জিতানোর কাজ ছিল। যেন আমি দেশকে কিছু দিতে পারি।’ এই ছেলেটি তার কথায় নয়, কাজেই নিজেকে অসামান্য করে তুলছে। আর কিছু নয়, আমাদের এ উপলব্ধিটুকুই দরকার। ছেলেমেয়ে না হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক না হয়ে খেলোয়াড়ই হোক। এত লক্ষকোটি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকসমাজের একজন মুস্তাফিজ না হয় নাই হলো কিন্তু এই এগারোজন খেলোয়াড়ের মাঝে একজন মুস্তাফিজ না থাকলে বাংলাদেশ আজ উচ্ছ্বাসহীন, উদ্দীপনাবিহীন, মলিন। থাকুক না ওরা একটু স্পেশাল। হোক না ক্রিকেটার, বক্সার অথবা ফুটবলার। তাতে দেশের কোনো ক্ষতি নেই বরং লাভ । কারণ দেশ আজ ভরসা করে আছে তাদের ওপর, যারা তাদের ঘামের প্রতিটি ফোঁটায় চায় বিজয়। যাদের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ক্ষিপ্র চাহনি, সুকৌশলী বল অথবা ঝড়ো ব্যাটটি আজ ঘায়েল করবে বিশ্বসেরা দলকে। যাদের খেলার উন্মাদনায়, উন্মত্ততায় প্রতিটি ক্যাম্পাসে হবে আনন্দ মিছিল, বাঁধভাঙা আনন্দ করবে ছেলেমেয়েরা, দলে দলে নাচবে, গাইবে, চিৎকার করে বলবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। বাজবে ভুভু জেলা, ভারতকে করা হবে হোয়াইটওয়াশ। ভাইদের কাছে বুকভরা আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছি পৃথিবীর সব প্রান্তের সব বাঙালি। সিরিজ জয় হয়েই গেছে, এবার আশায় আছি হয়তো আবারও মুস্তাফিজের বলেই হবে কাঙ্ক্ষিত বাংলাওয়াশ।
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর