অভিমত
ফরহাদ মজহার ও অসহায় আমরা
একসময় নিশ্চিত হওয়া গেল যে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ। আমাদের অনেকের কাছে এই নিখোঁজ হওয়াটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ, যে মানুষকে চিনি-জানি, তাঁর নিখোঁজ হওয়াটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, তাঁর মতো মানুষ যদি এভাবে হারিয়ে যেতে পারে তবে অন্যদের কী দশা হতে পারে! ঘটনাটি হারিয়ে যাওয়া হতে পারে, লুকিয়ে থাকা হতে পারে, নাটক হতে পারে, আরো অনেক কিছু হতে পারে। কিন্তু একটা মানুষ যখন হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়, তখন আমাদের বুকে সেটা আঘাত করে। আমাদের সবার নিরাপত্তাবোধের ভিত্তি কেঁপে ওঠে।
ফরহাদ মজহারকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, তার মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা প্রকাশ করেছেন। আশা করেছেন, তিনি ফিরে আসবেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শত্রু-মিত্রু নির্বিশেষে এই কথাটা সবাই বলেছেন। কিন্তু কিছু মানুষ এটিকে ব্যবহার করেছেন ফরহাদ মজহারকে আক্রমণ করতে, এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে। ফেসবুকে অনেক পোস্ট ছিল সেই রকম। এতে দুঃখিত হওয়া ছাড়া অন্য যে ভাবনাটা মনে আসে সেটা হলো, আমাদের সমাজ কতটা সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে।
মনে হয়েছে যে, তাঁর নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে একে অন্যকে মন্দ বলাটা মূল্য উদ্দেশ্য। রাজনীতি আমাদের এমনভাবে গিলে বসেছে যে, স্বাভাবিক মানবিক বোধগুলো তার কাছে পরাজিত। এটা সব পক্ষের জন্য প্রযোজ্য।
ফেসবুকের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক। হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজের বিষয়ে লিখেছেন এবং এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব হয় যাতে করে সরকার এবং অন্যান্য সবাই বিষয়টির দিকে নজর দেন। আমরা এখনো বলতে পারি না, কীভাবে কী হয়েছে, কেন হয়েছে ইত্যাদি। তবে চাপের কথাটা যদি কেউ বলে সেটা সামাজিক মাধ্যম থেকেই এসেছে এখনো আসছে। উপসংহার যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আবার প্রমাণ হলো যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের প্রধান গণমাধ্যমের অবস্থান নিয়েছে এবং পেশাদারি গণমাধ্যমের চেয়ে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে ও সবল হচ্ছে।
পেশাদারি গণমাধ্যম নিয়ে কথা বলতে বাধ্য আমরা। কারণ, এই কয়েক দিনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যেভাবে খবর পরিবেশন করেছে, তাতে করে এসব গণমাধ্যম মানসম্পন্ন কি না সে ব্যাপারে গভীর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে অনেকের মনে।
বিষয়টা হলো পাবলিক বলে একটা জিনিস আছে, যারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা গ্রহণযোগ্য নয়। একপেশে সংবাদ এবং মন্তব্য দিয়ে এই প্রচেষ্টা চালালেও শেষপর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই সব গণমাধ্যম ও কিছু ব্যক্তি যারা এটা করেছে। ফরহাদ মজহারকে অপছন্দ করাটা কোনো বিষয় নয় এখানে, এমনকি তাঁকে ঘৃণা পর্যন্ত করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে গণমাধ্যমের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করতে হবে কেন, সেটা বোঝা যায় না। মানসম্পন্নতার পরীক্ষায় সবাই পাস করতে পারেনি। যারা করেনি, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমরা আশা করব যে, ফরহাদ মজহারের নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উন্মোচিত হবে এবং প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। এই ঘটনা এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে যে, রহস্য বের না হয়ে আসাটা সব পক্ষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক হবে। এই কারণে এই রহস্যের কষ্ট থেকে আমরা সবাই মুক্তি চাই এবং আশা করব যে, এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে। সবাই ফরহাদ মজহার নয়। এই সমাজের প্রায় সব মানুষই অসহায়, তারা হারিয়ে গেলে খোঁজ করার কেউ থাকে না। এই কথাটা প্রতিদিন আমাদের স্মরণ করা উচিত।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক