স্মরণ
হুমায়ূন আহমেদ নামা
বাংলা সাহিত্যে স্বল্প কয়েকজন মানুষ এসছেন, যাঁরা তাঁদের লেখার জন্য মানুষের কাছে এতটা সমাদ্রিত। যাঁর উপন্যাস তারুণ্যের মানসিকতা গড়েছে , নাটক দেখে মানুষ রাস্তায় নেমেছে , যাঁর সিনেমা দেখতে মানুষ ভিড় করেছে। তিনি যে জগৎ নিয়ে লিখেছেন , সেটি বাঙালি মধ্যবিত্তের রূপ-চেহারা। কিন্তু অনেক অর্থে তিনি একটি বিকল্প জগৎ তৈরি করেছিলেন , যাতে তাঁর পাঠকরা নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের পাঠকরা বাংলাদেশের নরম-শরম মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যারা একটু-আধটু প্রেম করে , একটু-আধটু বাঁচে , যাদের জীবনের পরিসীমাই এই একটু-আধটু। কিন্তু তিনি তাঁর চরিত্রদের এমনভাবে উপস্থিত করেন যে তার পাঠকের কল্পনা জগতকেই প্রসারিত হয়। সেই জগতে প্রবেশ করে তাঁর পাঠকরা নিজেদেরকে অন্য কোনো বৃহত্তর অবয়বে দেখতে পান। সেখানেই হুমায়ূন আহমেদের সাফল্য। যে সাফল্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অন্য কারো তুলনা করা কঠিন।
হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীনতার পর পরই লিখতে শুরু করেন। সেই কারণেই তিনি একজন ক্রান্তিকালীন মানুষ ও লেখক। তাঁর বাবা পুলিশের চাকরি করতেন , যাকে পাকিস্তান আর্মি হত্যা করে। হুমায়ূন ভালো ছাত্র ছিলেন এবং বহু দিন আগে বিচিত্রায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , তাঁর লেখাপড়াই ছিল তাঁর পরের জীবনের কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতি। দেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াটাই ছিল তাঁর জীবনের অবধারিত এবং তিনি সেটা হয়েছিলেন। কিন্তু সেই চাকরি তিনি এক সময় ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে কথাশিল্পী ও ছবিয়াল বনে যান , অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সীমাবদ্ধ মধ্যবিত্ত জীবনকে অতিক্রম করে। এটিও ছিল পরিবর্তিত ও বিবর্তিত মধ্যবিত্তের স্বরূপ। লেখক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর শ্রেণির বাইরে যাননি।
যারা ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়েছেন, তারা দেখবেন এই অসাধারণ সফল দুটি উপন্যাসে তিনি বাস্তববাদী ছিলেন। নিজের অভিজ্ঞানগুলোকে শিল্পে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাফল্য হচ্ছে , তিনি যে শ্রেণির প্রতিনিধি ও যাদের জন্য লিখেছেন , তারা যে পরিবর্তিত হচ্ছিল এটাও তিনি বুঝেছিলেন। সে কারণেই তাঁর লেখার পরিবর্তনগুলো একটি নতুন পরিসর তৈরি করে। তিনি একের পর এক চরিত্র তৈরি করে গেছেন , যেগুলো বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে স্থান করে নিয়েছে। তিনি কেবল বাস্তব দেখাননি , দেখিয়েছেন কল্পনার জগৎ , পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। তিনি তাঁর পাঠককে বলছেন , ‘নিজেকে দেখ , এ রকমই তুমি দেখতে’। পাঠক ও দর্শক একমত হয়েছেন। প্রকৃত অর্থে তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসিকতা নির্মাণের অন্যতম স্থপতি।
হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষক হিসেবে সাধারণ মধ্যবিত্ত ছিলেন। শোনা যায় , তিনি একটা নতুন টেলিভিশন কেনার জন্য তাঁর যুগান্তকারী টিভি সিরিয়াল ‘এই সব দিনরাত্রি’ লেখেন। যাঁরা এটি দেখেছেন তাঁরা জানবেন , এটি কেবল বাঙালি মধ্যবিত্তের নির্ভরযোগ্য প্রতিবিম্ব ছিল না , এটি তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল যে তারা আছে , শত বাধার মধ্যেও তারা টিকে আছে , এটাই তাদের সাফল্য। শত বাধা-ব্যবধান ডিঙিয়ে মধ্যবিত্তরা এখনো আছে। মধ্যবিত্তরাও যে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ , এটা হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে বোঝাতে পেরেছিলেন , এটা আমাদের সাহিত্য জগতে আর কেউ পারেননি।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের গুরুত্ব নিয়ে মাঝে-মধ্যে কথা হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন সাহিত্যের সীমাবদ্ধ গণ্ডি উত্তীর্ণ মানুষ। যারা হুমায়ূন আহমেদকে সীমাবদ্ধ সাহিত্যিক বলেন বা তাঁর লেখার মর্যাদা স্বল্পকালীন বলে দাবি করেন , তাদের পক্ষে বোঝাটা হয়তো কষ্টকর যে তিনি বাংলা সাহিত্যের এমন একজন লেখেক যিনি গোটা সাহিত্যের ধারা, বাজার, পাঠক শ্রেণি তাদের কল্পনার চরিত্রসমূহ এবং ভাবনার জগতকে নিজের লেখার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এর চেয়ে বড় সাফল্য অসম্ভব। কারণ , এত মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা খুব কম লেখক সঙ্গে করে এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে। যদিও তিনি সুনিলকে রোল মডেল ভাবতেন , হুমায়ূন আহমেদই বাংলাদেশের পাঠকদের ঘরে টেনে আনেন। এক অর্থে আজকের পাঠকরা প্রায় অনেকটাই তারই সৃষ্টি।
হুমায়ূন আহমেদ কোথায় শেষ এবং তাঁর চরিত্রটা কোথা থেকে শুরু এটা বোঝার উপায় নেই। বিভিন্ন চরিত্রকে তিনি আমাদের সামনে উপস্থিত করেছিলেন যেমন হিমু, মিসির আলী ও অন্যান্য , যারা জীবিতদের চেয়েও অনেক বেশি ঘনিষ্ট আমাদের। এরা অদ্ভুত চরিত্র , ব্যতিক্রমি চরিত্র এবং সাধারণ সীমাবদ্ধ মধ্যবিত্ত বাংলাদেশির মতো নয়। বাকের ভাইয়ের মতোর ফাঁসির আসমি প্রায় কেউই হয় না। কিন্তু এই চরিত্রই আমাদের এত ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছিল যে তার জন্য বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নামতে রাজি ছিল।
যে জাতি ইতিহাসে রাজনীতির পট পরিবর্তনের জন্য রাস্তায় নামে , তারাই যখন একটি কাল্পনিক চরিত্রের প্রাণ বাঁচাতে রাস্তায় মিছিল করে তখনি আমরা বুঝতে পারি , সেই সাহিত্যিক কত বিশাল এক অবয়ব নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। আমাদের মনোজগতে বসবাস করে। সেই কারণেই তিনি বিতর্কিতও হয়েছেন, তাঁর পারিবারিক জীবন নিয়ে। কারণ , তিনি লেখক ছিলেন না , তিনি ছিলেন একটি গোটা শ্রেণির মানসিকতার নির্মাতা।
ধন্যবাদ হুমায়ূন আহমেদ , বাংলাদেশে জন্মাবার জন্য।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক