উন্মাদীয়
ছোটবেলার ঈদ
আমাদের ছোট বেলায় ঈদের চাঁদ দেখার একটা ব্যাপার ছিল। এখন যেমন শুধু চাঁদ দেখা কমিটিই চাঁদ দেখে আর কেউ দেখে বা দেখার আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমাদের ছোট বেলায় ঈদের চাঁদ দেখা একটা মিশন ইম্পসিবলের মতো ব্যাপার ছিল যা শেষ পর্যন্ত আমরা পসিবল করে ছাড়তাম। কে কার আগে চাঁদ দেখেছে এবং কীভাবে দেখেছে এর একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত সবার মধ্যে। আকাশে খালি চাঁদ উঠলেই হবে না। সেই চাঁদ আমাদের দেখতেই হবে। নইলে পরের দিন যেন ঈদই হবে না।
এবং চাঁদ দেখার পর ওই রাতেই কাগজ কলম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তাম ঈদকার্ড বানাতে। নারকেল গাছের আড়াল দিয়ে উকি দিচ্ছে কাস্তে বাকা চাঁদ। পিছনে একটা রকেট! (আসলে রকেট না মসজিদের মিনার অঙ্কন শিল্পের গুনে রকেট মনে হচ্ছে)। সেই কার্ড আবার সেই রাতেই বন্ধুদের কাছে পৌছাতে হবে। না পৌছাতে পারলে যেন ঈদই মাটি!
ঈদের দিন ভোরে বাবা রেডিও ছেড়ে দিতেন উচ্চস্বরে সেখানে বাজতে থাকত কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত গান ‘মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...এল খুশির ঈদ...’ এই গানের শব্দেই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠতাম। তারপর গোসল করে পাজামা পাঞ্জাবি পরে ছয় ভাই বোন সেজেগুজে বেড়িয়ে পড়তাম বাবার সাথে ঈদগাহ মাঠের উদ্দেশে। তিন বোন আশপাশে কোথাও অপেক্ষা করত আমরা তিন ভাই বাবার সাথে নামাজ পড়তাম।
নামাজের পর শুরু হতো আসল ঈদ। বাসায় ফিরে পাজামা পাঞ্জাবি বদলে ঈদের জামা জুতা পরে ছুট বন্ধুদের সাথে বাসায় বাসায়। প্রত্যেক বাসায় খাওয়া জরুরি।কে কটা বাসায় খেল এটাও এক প্রতিযোগিতা যেন। আর বাসার খালাম্মারাও না খাইয়ে ছাড়তেন না।
আসলে আমাদের ছোট বেলার ঈদ এতই আনন্দের হতো যে দম ফেলার সময় হতো না। যেন দম ফেললেই দু-একটা ছোটখাট আনন্দ মিস করে যাব।একেক সময়ে একেক আনন্দ। সকালে এক আনন্দ দুপুরে আরেক রকমের আনন্দ বিকেলে আরেক ধরন... আর সন্ধ্যায় সবচে বড় আনন্দ ... বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে পাড়ার কোনো বাসার বারান্দায় স্টেজ করে বিচিত্রানুষ্ঠান। তখন আশপাশে কোনো বাসায় টিভি ছিল না। টিভি কী বস্তু জানতামই না। তাতে আমাদের আনন্দ কিন্তু কিছু কম হতো না। এই বিচিত্রানুষ্ঠানই আমাদের চাররঙা বিয়াল্লিশ ইঞ্চি টিভি যেন। সেখানে নাটক হতো গান হতো নাচ হতো... কত আনন্দই না হতো। আমরা ছোটরাও মাঝে মধ্যে অভিনয় করার সুযোগ পেতাম।
ব্যাপারটা এমন নয় যে আগে ছোটবেলার ঈদে অনেক আনন্দ ছিল এখনকার ছোট বেলার ঈদে আনন্দ কম তা নয়- এখন বরং আনন্দ আরো বেশি। টিভিতে কতরকম অনুষ্ঠান থাকে, ঈদ সংখ্যা পত্রিকায় কত রকম লেখা থাকে, পোশাক আশাক তো আছেই, সেলামি বাণিজ্যও বাচ্চাদের জন্য কম আনন্দের না। আমি তো এক বাচ্চাকে চিনতাম যে সেলামির টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে এখন বিরাট ব্যবসায়ী , নিজেই এখন মোটা হাতে সেলামি দেয়!
আমাদের ঈদ শেষ হতো কান্না দিয়ে। গভীর রাতে আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় বোন কান্না শুরু করতাম। ঈদ শেষ হয়ে যাওয়ার কান্না। মা বলতেন
- কাদিস কেন?
- ইইই (কান্না) ঈদ শেষ হয়ে গেছে
- আরে বোকা এক ঈদ গেছে আরেক ঈদ তো এলো বলে
- আরেক ঈদ? আমরা দুজনেই অবাক
- আরে দুই মাস পরই তো কোরবানির ঈদ !
তারপর আর কি, কোরবানি ঈদের স্বপ্ন নিয়ে হাসি মুখে ঘুমাতে যেতাম। আর কী আশ্চর্য ... সেদিন হঠাৎ হিসাব করে দেখি ছোটবেলায় আমাদের যে মা কোরবানির ঈদের কথা বলে আমাদের কান্না থামাতেন, তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী পড়েছে আগামী কোরবানির ঈদে ! আর এই রোজার ঈদের পরের দিনই বড় ভাইয়ের মৃত্যু বার্ষিকী !! কে জানে কেন আনন্দের দিনগুলোতে এই কষ্টের কড়া নাড়া ?