উন্মাদীয়
পুলিশ! পুলিশ!!
আমাদের এক পরিচিত বন্ধু ছিল। যেকোনো চাকরি-বাকরি পাচ্ছিল না দেখে হতাশ হয়ে একদিন সিদ্ধান্ত নিল, সে তার সব সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলবে। শুধু ক্লাস এইটের সার্টিফিকেটটা রাখবে।
—কেন, শুধু এইটের সার্টিফিকেট রাখবি ক্যান? আমরা জানতে চাই। সে বলে, এইটের সার্টিফিকেট দিয়ে পুলিশের কনস্টেবলের চাকরি নেব। তার পর সবাইকে ইচ্ছামতো মনের ঝাল মিটিয়ে পেটাব। তোদেরকেও পেটাব (যেহেতু আমরা চাকরি-বাকরি পেয়ে গেছি তার আগেই)।
এখন যখন পত্রপত্রিকায় ছবি দেখি পুলিশ কাউকে বেধড়ক পেটাচ্ছে, তখন আমার বন্ধুর কথা মনে পড়ে। এই কি সেই পুলিশ, যার সব সার্টিফিকেট আছে, কিন্তু চাকরি না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে, সব সার্টিফিকেট ছিঁড়ে এইটের সার্টিফিকেট নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল হয়ে সবাইকে পেটাচ্ছে... ?
না, আমি পুলিশকে এমনটা ভাবতে চাই না। পুলিশ শব্দের (এভ্রিভিয়েশনে) প্রথম শব্দটা পি, পি ফর পোলায়েট! এটা কি পুলিশরা জানেন না? জাপানের পুলিশরা নাকি যখন কোনো অপরাধীকে ধরে বা ধরতে যায়, তখন তাকে প্রথমে মাথা নিচু করে বো করে, তার পর লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে, ‘তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে বলে আমি অতীব লজ্জিত!’
আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। সে কারণে পুলিশদের প্রতি আমার একট সফট কর্নার আছে। আমার বাবা কেমন পুলিশ অফিসার ছিলেন, সেটা ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের জীবনী পড়লেই জানা যাবে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার একবার কুমিল্লার অদূরে কোনো একটা নির্জন হাইওয়েতে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে রাস্তায় ভয়ানক আহত হয়ে পড়ে ছিলেন। তিনি বারবার চেষ্টা করছিলেন কাউকে থামাতে, কেউ তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছে দিক। কিন্তু কেউ থামছিল না, তখন একটা পুলিশের গাড়ি থামল। নেমে এলেন আমার বাবা (তিনি তখন কুমিল্লার ডিএসপি ছিলেন)। তিনি নিজেই স্যারকে পাঁজাকোলে তুলে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। শুধু তা-ই নয়, পরে তিনি একাধিকবার হাসপাতালে গিয়ে তাঁর দেখভাল করেছেন।
একবার আমার মাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে দেখতে। অনেক পরে তিনি জানতে পেরেছিলেন, এই পুলিশ অফিসার বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের বাবা। আমি সব পুলিশ অফিসারের মধ্যেই আমার শহীদ পিতার ছায়া খুঁজি; কিন্তু যখন দেখি অন্যচিত্র, তখন ভীষণ মন খারাপ হয়। পুলিশ কেন এমন হবে? পুলিশ তো হবে সাধারণ মানুষের দুঃসময়ের বন্ধু... সে কেন কারণ ছাড়াই শত্রু হয়ে উঠবে?
ছাত্র ইউনিয়নের এক নারী নেত্রীকে বেধড়ক পেটাচ্ছে—এমন ছবি ছাপা হয়েছে সব পত্রিকায়! মহিলা পুলিশও নয়, পুরুষ পুলিশ পেটাচ্ছে একজন নারীকে। যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা দুজনই আমাদের দেশের দুই সম্মানিত নারী!
আলেকজান্ডার বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর সেনাপতিকে ডেকে বলতেন, ‘সেলুকাস, সত্যিই কি বিচিত্র এই দেশের পুলিশ বাহিনী...!’
একটা সুন্দর কোটেশন আছে, ‘তুমি কাউকে আঘাত করার আগে একবার অন্তত ভেবে নিও তুমি একটি পবিত্র মাতৃগর্ভ থেকে এসেছ... তুমি মানুষ বলেই আরেকজন মানুষকে কখনই আঘাত করতে পারো না!’
যে পুলিশরা নারী নেত্রীকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদের নাকি সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আমার মনে হয়, আমাদের সবকিছুই এখন ‘সাময়িক’ শব্দটার মধ্যে আটকে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র বা ছাত্রনেতা অনৈতিক কাজ করলে তাকেও সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। সবকিছুই সাময়িক। সবকিছুতেই আমরা কবে ‘স্থায়ী’ হবো, কে জানে!
আহসান হাবীব : কার্টুনিস্ট, সম্পাদক, উন্মাদ পত্রিকা