‘বজরঙ্গি’-তে এ কোন সালমান : শোভা দে
শোভা দে ভারতের প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ও কলামিস্ট। জনসংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া সালমান খানের নতুন ছবি ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ তিনি যাচাই করেছেন ভিন্ন এক আঙ্গিকে। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে গতকাল শনিবার ১৮ জুলাই এনডিটিভির অনলাইন সংস্করণে।
দেখুন, এই ভোলাভালা গুডবয় সালমানকে নিয়ে আমার বেজায় আপত্তি। আমি সবসময়ই ধুন্ধুমার ডায়লগবাজ, চোখের পলকে শার্ট খুলে ফেলা, রাস্কেল সালমানকেই পছন্দ করি। কারণ সে এমনই, এটাই তাকে মানায়। বলতে পারেন যে আমি এই স্টেরিওটাইপে বিশ্বাসী। এটা স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই। আর এ কারণেই, পুরো ১৫৯ মিনিট ধরে বসে থেকে এই মিষ্টি রস গিলে বাসায় এসে ঠিক সুস্থ থাকতে পারিনি। আমার ডায়বেটিস নেই, নয় তো এতক্ষণে ঠিকই ইনসুলিনের বাড়তি ডোজ নিয়ে নিতাম!
কোনো সন্দেহ নেই বজরঙ্গি ভাইজান শত শত কোটি রুপির ব্যবসা করতে যাচ্ছে। এটা এক্কেবারে পরিষ্কার। আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি সিনেমায় ম্যানিপুলেশন হজম করতে পারি না। এই দোষ অনেক ছবিরই আছে, তবে এই ছবির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা কারণ এটির রয়েছে একটি ‘সাব-টেক্সট’ ।(সাব-টেক্সট কি সে বিষয়ে আলাপে এখন না যাই- আপনারা যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন খবরে কীভাবে হাই প্রোফাইল অপরাধীদের সংবাদ প্রচার করা হয়, আপনি সেসব কনটেক্সট জানেন।) আর সাব-টেক্সট এই চলচ্চিত্রের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে, কীভাবে? পুরো বিষয়টাকে বেশ কার্যকরী গুঁড়ো সাবানের বিজ্ঞাপনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে (‘আমার শার্ট সবচে সাদা’ )।
যতক্ষণ ধরে দর্শক, ‘ভাইজান’-এর কর্মকাণ্ড দেখবেন, ততক্ষণই এই পুরো বিষয় ঘটমান। ছবির আসল বক্তব্য কী, মেসেজ কী- সেটাকে উপেক্ষা করার সুযোগই পান না কোনো দর্শক। আর একইসাথে পাক-ভারতের সেই পুরনো আমরা ‘একে অন্যের ভাই-ভাই’ থেরাপি, একে আরো সুস্বাদু ইমোশনাল মেলোড্রামা বানিয়েছে সহজেই। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, ছবির নির্মাতা ও পুরো টিমেরই উদ্দেশ্যটা ছিল ভিন্ন। তারা এমন একটি থিম নির্বাচন করেছে এবং সেটা নিয়ে কাজ করে গেছে সাবধানে- যার মাধ্যমে সালমানকে একজন ‘মৃত্যুকে জয় করা’ ভালো মানুষ, সৎকর্ম পালনকারী, সত্যবাদী হিসেবে দেখানো যায়। একইসাথে, সে যেন একটা পোকার গায়েও হাত তোলে না কখনো (যদি না পোকা তার একেবারে গায়ে এসে পড়ে, যেমন ধরুন পতিতালয়ে মারামারির দৃশ্যটা)! এ অবস্থায়, আমি নিজেকে বললাম, ‘আচ্ছা, একটা কাজ করলে বেশ হয়। পুলিশ আর বিচারকদের জন্য একখান স্পেশাল স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করলে পুরো বিষয়টা তো বেশ কাজে দেবে! ওই যে, যে গাড়িচাপা দেওয়ার কেসটা চলছে না, ওটার জন্য। এই ছবির ইমোশন বেশ কাজে দেবে কিন্তু!’
বোকাসোকা, ভোলাভালা হিসেবে সালমানকে দেখানোর আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ। কিন্তু এই বোকাসোকা মানুষটার কাজকর্মের পাল্লা আর মাপ এতই বিস্তৃত, অনেকে দেখলেই এই লোকটার ‘ভালো মানুষি’ নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে পারেন। শুধু একবারই ছবিতে চিরচেনা, ‘আসল’ সালমানের একটু ঝলক মিলল, সালমানের কড়া ঠাট্টার সেই ডায়লগ। সালমানকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘ভাইয়া, ইয়ে সেলফি কেয়া হোতা হ্যায়’ (ভাইয়া, এই সেলফি জিনিসটা কী)? উত্তরে ‘ভাইজান’ সালমান বললেন, ‘যব খুদ কি লেতে হ্যায় না... (যখন নিজেই নিজের....) লম্বা বিরতি দিয়ে.. তসভির’ (ছবি তোলে!)- এই মসকরায় আমরা কিন্তু অরিজিনাল, ব্র্যান্ড সালমানকে খুঁজে পাই! আর কি সতর্ক আর সুক্ষভাবেই না পরিচালক কবির খান এই ব্র্যান্ড সালমানকে পুরো ছবিতে পরিচালনার আবরণে ঢেকে রেখেছেন, এক ‘হনুমান ভক্ত’ সালমানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন পুরো ছবিতে, যে কি না বানর দেখলেও প্রণাম ঠোকে! অন্য কারো কথা জানি না, পুরো ছবি ধরে আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম, এই বুঝি এই সুইটনেসের ন্যাকামি আর ভড়ংটা ঝেড়ে আসল সালমান বেরিয়ে আসবে। পুরোটা সময় ধরে এই অপেক্ষাটা করেই যেতে হয়েছে!
যখনই সালমান কোনো ফ্রেমে এসেছেন, আমরা আটকে থেকেছি। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে, তাঁকে কিন্তু ছয় বছরের এক স্বর্গীয় মুখাবয়বের শিশুর সাথে পাল্লা দিতে হয়েছে- যে অনেকটা পুরো ছবিই সালমানের দখল থেকে কেড়ে নিয়েছে। মিষ্টি এই শিশুটির নাম হর্ষালি মালহোত্রা, যে কোনো কথা না বলেই ছবিটাকে কেবল সালমানের ছবি নয়, বরং নিজের ছবি করে নিতে পেরেছে। আর হ্যাঁ, তারপর অবশ্যই, এখানে আছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী! প্রশ্ন আসতে পারে, নবাব বেগমকে (কারিনা) কবির খান আরেকটু আগেভাগে আনেননি ছবিতে? এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু আমার ওই টুইটের মতোই, ‘মোর নওয়াজ, লেস আওয়াজ’ (নওয়াজ বেশি, আওয়াজ কম!)। এই ছবিতে ওদের কথা বলতেই হয়।
এখন আসল প্রশ্ন আসতে পারে, আমি এত বিরক্ত কেন? আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন না, পুরো ছবির উপরে না। কেবল প্রথমার্ধের সময়টুকু। আজকালকার দিনে প্লট আর মোটামুটি একটা গল্পওয়ালা ব্লকবাস্টার পেলে দর্শক সেটাকে বিশাল ভাগ্য মনে করেন! আমরা সাধারণত নিরর্থক দৃশ্য, আর আজগুবি চেঁচামেচি মিলিয়ে ছবি দেখি। ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এ যাই হোক, একটা গল্প আছে- সব প্রশংসা আল্লাহ্র! এর একটা মোটামুটি একরৈখিক গতিপথ রয়েছে- প্রথাগত একটা শুরু, মাঝের কাহিনী এবং তারপরে শেষ। শুধু বাজে লেগেছে যখন ক্লিশে আর বিরক্তিকর উপাদানের জন্য ছবিটা আটকে আটকে ছিল! আর ধর্ম-বর্ণ এসব নিয়ে কয়েকটা অপ্রাসঙ্গিক আর বেখাপ্পা ডায়লগ বিরক্তিটা আরো বাড়িয়েছে।
ছবি হিসেবে হয়তো ঘৃণা ডিঙিয়ে ভালোবাসার জয়, শত্রুতা পেরিয়ে বন্ধুতা, সন্দেহ ছাপিয়ে সমানুভূতি-অনেক বিষয়েই হাততালি পাবে ‘বজরঙ্গি ভাইজান’। তবে সালমান ‘ভাই’-এর ভক্তদের জন্য এখানেই প্রশ্নটা এসে যাবে- ‘শান্তি আর ভালোবাসার দূত’ হিসেবে এই দারুণ ‘টাইমিং’ করা পারফরম্যান্স সালমানকে জেল হাজতের বাইরে রাখবে তো?