শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক ট্র্যাজেডি
বিশ্বে বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্র, যার স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে বহুরূপে বিপুল প্রাণকে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ আর পাঁচ লক্ষাধিক নারীর সর্বস্ব হারানোর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। সেখানে বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্মমতাও এক অনন্য পার্ট। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াতি আলবদর, আলশামস গোষ্ঠী মুক্তিকামী বাঙালির সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠতে না পেরে ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা আঁকে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাসে তা বাস্তবায়নও করে। সে সময় স্বাধীনতালাভের সুখবরের সঙ্গে সমাজের অগ্রগণ্য চিন্তকদের হারিয়ে ফেলবার মতো ভিন্নতর ট্র্যাজেডির মুখোমুখিও হতে হয় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশকে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনের নায়কদের ক্রীড়নক এ দেশীয় কোলাবরেটর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিক ও আলবদর-আলশামসের অধিকর্তা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, চৌধুরী মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে বিচারের আওতায় আনা গেছে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যায় পাকিস্তানি ‘মাস্টার মাইন্ড’-দের এখনো আমরা ছুঁতে পারিনি।
ইতিহাসে নৃশংসতম ও বর্বরোচিত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। তারা বাঙালি দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের সমূলে বিনাশ করবার ফন্দি আঁটে। লক্ষ্য ছিল, বাঙালি স্বাধীন হলেও যাতে কোনোদিন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চায় মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে। তবে আমরা এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পাকিস্তান ও তাদের এ দেশের সুবিধাভোগীদের সে আশা পূরণ হয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে বেশ অগ্রগামী।
মানবতাবিরোধীদের অপরাধ বিচারে আপিল বিভাগ তাদের পর্যবেক্ষণে আলবদরের নেপথ্যে একাত্তরে পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল আবদুর রহীম, লে. কর্নেল আহসানুল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার বশীর ও মেজর রিয়াদ হোসেন মালিকের কথা উল্লেখ করলেও আলবদরের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ যেসব অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সে জন্য এই পাঁচজনের একজনকেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গভর্নর হাউসে ফেলে যাওয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলীর ডায়েরির পাতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা পাওয়া যায় (যাঁদের অধিকাংশই ১৪ ডিসেম্বরে শহীদ হন)। বিভিন্ন আলোচনায় গণহত্যার কথা অস্বীকার করলেও ডায়েরির পাতায় এই তালিকার কথা ফরমান আলী নিজেও স্বীকার করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় বাহিনী অন্তত ১০ জন সেনা অফিসারকে ভারতে নিয়ে যায়, যারা বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে চিহ্নিত অপরাধী ছিল। পরে ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে সেসব অফিসার পাকিস্তানে ফেরত যেতে সক্ষম হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিচার আদালতে বিচার হয়েছে, যারা পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা ও মদদে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছে সেই চিহ্নিত এ দেশীয় দালালশ্রেণির দেশদ্রোহীদের। দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে হন্তারকগোষ্ঠী আলবদর ও আলশামসকে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ থেকে শুরু করে পুরো ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পাকহানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে নিধনযজ্ঞের স্বীকার হন। সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত নিরুপিত না হলেও দেশব্যাপী এ সংখ্যা এক হাজার ১১১ জন বলে জানা যায়। এর মধ্যে বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বরেই দুইশ বুদ্ধিজীবীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জীবিত মানুষের চোখ উৎপাটন করে বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে ফেলে দেয় ঘাতকরা।
১৯৩৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে গেস্টাপো নামে গুপ্ত পুলিশ বাহিনী গঠন করে। তাদের কাজই ছিল নাৎসিবাদের বিরোধীদের খুঁজে বের করে অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমে শায়েস্তা করা। একাত্তরে আলবদর বাহিনীও সেই গেস্টাপো কায়দায় কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে টর্চার সেলে নিয়ে যেত। তাদের সেই নির্মমতার সাক্ষী হয়ে আছে রায়েরবাজার, আলেকদি, কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বা বাঙলা কলেজের পেছনে।
এসব বধ্যভূমির ট্র্যাজিক মহাকাব্য যাদের রক্তে ভাস্বর, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরো অনেকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও কয়েকজন শহীদ হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্য ছবি ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর নির্মাতা জহির রায়হান অন্যতম।
স্বাধীনতার পর জহির রায়হানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তথ্যানুসন্ধান কমিটি’। ২২ ডিসেম্বর এই কমিটি কাজও শুরু করে। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান, যার খোঁজ আজো মেলেনি।
একাত্তরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিজীবী হত্যার ছক কষে ঘাতকরা। এ ব্যাপারে ভূরাজনৈতিক ইতিহাসে সাক্ষ্যের অভাব নেই। পাকিস্তানি গবেষক ও লেখক সেলিম মনসুর খালেদ তাঁর আলবদর বইয়ে একাত্তরে আলবদর গঠনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে রেখেছেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভারতীয় লেখক ক্যাপ্টেন এস কে গার্গের লেখা ‘স্পটলাইট : ফ্রিডম ফাইটার অব বাংলাদেশ’ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘আত্মসমর্পণের ঠিক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষকসহ তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা তৈরি করে সিআইএ, যাদের জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর দিয়ে দ্রুত নির্মূলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
ঢাকার তৎকালীন মার্কিন কনসাল হার্বাট ডি স্পিভাক ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা ৫৬৯৬ ক্রমিকের এক তারবার্তায় লিখেন, “আত্মসমর্পণের শর্ত যাতে ন্যায্য হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় সমর্থক ও রাজাকাররা প্রায় ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে ‘জিম্মি’ করেছিল। আত্মসমর্পণের দুদিন আগে অনেককে হত্যা করা হয়। স্থানীয় লোকজন বলছেন, ইটখোলা এলাকায় অনেককে ধরে এনে হত্যা করা হয়। কথিতমতে, রাজাকাররা এখনো ইটখোলা দখলে রেখেছেন।”
পরে ১৯৭২-এর ২ ফেব্রুয়ারির তারবার্তায় স্পিভাক নির্দিষ্টভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানান, ‘জামায়াতের দুর্বৃত্তরাই’ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এ-সংক্রান্ত বাক্যে স্পিভাক ‘জামায়াত থাগস’ বা ‘জামায়াতের দুর্বৃত্ত’ শব্দ ব্যবহার করেন।
১৪ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর লেখা ‘পাকিস্তান ও আলবদর’ নামে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় দৈনিক সংগ্রামে। সেখানে নিজামী লিখেন, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেইসব গুণাবলির কথা আমরা আলোচনা করেছি, আলবদর তরুণ মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সেই সব গুণাবলি আমরা দেখতে পাব।’
পুরো একাত্তর সালজুড়ে বিভিন্ন সভায় নিজামী বিভিন্ন সভায় বয়ান করেন, ‘যারা ইসলামকে ভালোবাসে, শুধু তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।’
জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ রূপান্তরিত হয়ে আলবদর নাম ধারণ করে। এবং ওই ছাত্রসংঘের নাজিম-ই-আলা বা প্রধান মতিউর রহমান নিজামীই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সহযোগী হিসেবে প্যারামিলিটারি আলবদর গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখেন। আর ইতিহাসের এই জঘন্য সংগঠনের সদস্যরা অখণ্ড পাকিস্তানকে আল্লাহর ঘর আখ্যা দিয়ে নারকীয় হত্যা ও নারী ধর্ষণে মেতে ওঠে। দেশটাকে বানিয়ে ফেলে ‘কিলিং স্কোয়াড’। বাংলাদেশি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ বা মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি অবুঝ শিশু কিংবা বয়োবৃদ্ধ নারীরাও এসব হায়েনার কাছ থেকে রক্ষা পায়নি। মানুষের অমূল্য প্রাণ ও মনুষত্য বোধ বিনাশে ধর্মের এমন ন্যক্কারজনক ব্যবহার পৃথিবীর তাবৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসেই এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বলা হয়ে থাকে, বুদ্ধিজীবীরা তত্ত্বসর্বস্ব। অনেকেই অভিযোগ করেন, তাঁরা ভীতি ও সুবিধাবাদেরও শিকার হন। তারপরও কোনো একটি রাজনৈতিক বা আদর্শিক আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে সম্ভাব্য সর্বাধিকসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে পক্ষে আনা অতি প্রয়োজনীয় বলেই মনে করে থাকেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। শিক্ষক, অধ্যাপক, গবেষক, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিশেষজ্ঞ যাঁরা বিদ্যা, অধ্যয়ন ও মেধাভিত্তিক পেশার মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করেন, তাঁরা দেশের জনমত গঠন ও তা পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আপামর জনসাধারণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দখলদারদের রোষানলে পড়ে বড় করুণভাবে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে নিজেদের প্রগতিশীল চিন্তা ও ভাবনার দায় চুকান। ভীতি ও সুবিধাবাদের কাছে হেরে না গিয়ে দেশকে ভালোবাসবার নজির স্থাপন করে গেছেন তাঁরা। বাঙালি ভীষণ দুঃখের ডালি ভরে নিয়ে সেই বীরদের জন্য নিশ্চিতই অর্ঘ্য সাজাবে। হাজার বছরের তিমির কাটিয়ে আলোর প্রভাত এনে দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের বন্দনা হোক অহোরাত্রি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।