সোশ্যাল মিডিয়া, প্রতিরোধ আর সামাজিক পরিবর্তন
কোনো সমাজে বিভিন্ন অসংগতি আর অন্যায় দৃশ্যমান হলেও কখনো সনাতন গণমাধ্যমগুলোর উপস্থাপিত বিষয়ে মানুষকে সমাজ-সচেতন করে তোলার পরিবর্তে জড় আর নিষ্ক্রিয় করে রাখার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। ভোগবাদিতা আর মুনাফা অর্জন যদি একটি সমাজে প্রবলভাবে প্রাধান্য পেতে থাকে, তাহলে গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুতেও বিদ্যমান ব্যবস্থা আর প্রভাবশালী মতাদর্শের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতাই চোখে পড়ে। গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদ আর বিভিন্ন আলোচনা উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলা হয় দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য; চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীতে সমাজ-সচেতন বক্তব্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় চাকচিক্য আর বিনোদন। দর্শককে আনন্দ জোগানোর মধ্য দিয়ে সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকা শোষণের বিভিন্ন রূপ ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে ভোগ্যপণ্য, একটি উৎস থেকে অগণিত দর্শকের কাছে সেই বিষয়বস্তু বিতরণ করা হয়। আর দর্শক নিষ্ক্রিয়ভাবে গণমাধ্যমে উপস্থাপিত বক্তব্য গ্রহণ করতে থাকেন, হয়ে ওঠেন কেবলই কনজিউমার বা ভোক্তা। দর্শকের মানসিক সক্রিয়তা সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ যদি না নেওয়া হয়, তাহলে সমাজে বিদ্যমান অনিয়ম আর শোষণ সম্পর্কে দর্শকের সচেতন হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ থাকে না।
ফরাসি চিন্তাবিদ লুই আলথুসার মানুষের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাসগুলোর কথা। রাষ্ট্র কখনো সরাসরিভাবে সেনাবাহিনী বা পুলিশের সাহায্যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ না করে পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে জনগণের ওপর শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোই আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস যা ধারণ এবং বিতরণ করে প্রভাবশালী মতাদর্শ, যার ফলে মানুষ নিজেদের অজান্তেই বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অনুসারী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে নাগরিকদের ওপর দমননীতি চাপিয়ে দেয় না, ফলে সাধারণ নাগরিকরা মনে করেন, তাঁরা স্বাধীনভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষ শাসকদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতেই ভূমিকা রাখেন, নিজেরা অনুধাবনও করতে পারেন না, কীভাবে সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা আর গণমাধ্যমের সাহায্যে কৌশলীভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর পক্ষে যায় এমন চিন্তা মানুষের মনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সমাজে টিকে থাকে প্রভাবশালীদের শোষণমূলক আচরণ। সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো সচেতনতা আর মানসিক সক্রিয়তা সাধারণ মানুষ যেন অর্জন করতে না পারে, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে সমাজের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী।
মানুষ তাই নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও আসলে তাঁর চিন্তা সমাজের আধিপত্যশীল মতাদর্শ আর ডিসকোর্সগুলো দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়। যে সামাজিক ব্যবস্থা অন্যায় টিকিয়ে রাখে, তার বিরুদ্ধেও মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে না, অন্যায়ের বিভিন্ন সূক্ষ্ম ধরনও মানুষ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, যদি গণমাধ্যম আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থাপিত বক্তব্য মানুষকে সামাজিক আর রাজনৈতিক সচেতনতা প্রদানের পরিবর্তে, চিন্তাশীল আর মানসিকভাবে সক্রিয় করে তোলার বদলে তাঁদের করে তোলে অসাড় ও নিষ্ক্রিয়। সমাজের সাধারণ মানুষ তখন হয়ে পড়ে প্রশ্নহীন, অপ্রতিরোধী। আর এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকে একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা, যেখানে কেবল কিছুসংখ্যক লোকই লাভবান হয়। এ ব্যবস্থা পরিবর্তনের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা। সচেতন মানুষকে প্রতারিত করা সহজ নয়, কারণ তাঁর চিন্তার গভীরতা এবং সক্রিয়তা তাঁকে ভালো-মন্দের প্রভেদ বোঝার ক্ষমতা দেয়। একটি ভোগবাদী সমাজে মূলধারার প্রভাবশালী গণমাধ্যমে বহু মানুষকে শোষণের বিভিন্ন সূক্ষ্ম রূপ আর কর্তৃত্বময় মতাদর্শের নানা নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতন করার আন্তরিক উদ্যোগ সহজে দেখা যায় না। সমাজ কাঠামোই এ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে প্রধান বাধা এবং মূলধারার গণমাধ্যমও অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অবস্থা বা স্ট্যাটাস ক্যু বিরোধী অবস্থান গ্রহণে আগ্রহী হয় না।
ফলে সমাজে টিকে থাকা শোষণ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি প্রতিরোধ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন হয় বিকল্প ধারার গণমাধ্যম। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেও অলটারনেটিভ মিডিয়া তৈরি করা সহজ নয়, কারণ সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হাতেই থাকে সমাজ কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ, আর সেই গোষ্ঠী টিকিয়ে রাখতে চায় প্রভাবশালী মতাদর্শ আর ডিসকোর্স। প্রথাবিরোধী বক্তব্য এবং দর্শকের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস ক্ষমতাশীল শ্রেণির স্বার্থবিরোধী হয়ে ওঠে আর তাই এমন চেষ্টা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ার যে উদ্ভব ঘটেছে, তা সাধারণ মানুষের চিন্তা প্রকাশ এবং সচেতনতা অর্জনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে বন্ধন-মুক্তি বা ইমানসিপেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। পুরোনো গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের এজেন্সি বা সক্রিয় কর্মোদ্যোগের সুযোগ কম ছিল। দর্শক সেখানে কেবলই ভোক্তা, নির্দিষ্ট নির্মাতার তৈরি করা বক্তব্য দর্শককে সেখানে গ্রহণ করতে হচ্ছে, সক্রিয়ভাবে সেই বক্তব্য বিশ্লেষণের চেষ্টাতেও দর্শক প্রায়ই আগ্রহী হয় না, কারণ সনাতন গণমাধ্যমে মতামত বা সমালোচনা প্রকাশের সুযোগ সাধারণ দর্শকের জন্য সহজ নয় এবং কখনো সম্ভবও নয়।
কিন্তু বর্তমান সময়ে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শক আর কেবলই কনজিউমার নয়, বরং দর্শক এখন প্রোজিউমার কারণ, তারা একই সঙ্গে কোনো বক্তব্য প্রোডিউস বা সৃষ্টি করছে এবং তা ভোগ করছে। এই ক্ষমতা গণমাধ্যম-দর্শককে মুক্তি দিচ্ছে তার পুরোনো নিষ্ক্রিয়তা থেকে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রসারের জন্যই বর্তমান সময়ে মূলধারার প্রথাগত সাংবাদিকতার পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সিটিজেন সাংবাদিকতা। আজ যেকোনো ব্যক্তি তাঁর মোবাইল ফোনে বা ভিডিও ক্যামেরায় কোনো ঘটনার দৃশ্য ধারণ করে তা সম্পর্কে নিজের ব্লগ বা কোনো সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেন। হয়তো দেখা যাবে, এই প্রতিবেদনটি তখনো মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। ফলে যে কেউই আজ প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ প্রকাশে সক্ষম, যে সুযোগটি অতীতে ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাই সাধারণ মানুষের জন্য স্বাধীনভাবে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আজ আর কেবল একটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে সব সময় কোনো বক্তব্য বহু মানুষের কাছে যায় না, আজ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে বহু মানুষের তৈরি বক্তব্য পৌঁছে যাচ্ছে বহু মানুষের কাছে। নতুন এ পরিস্থিতির জন্য প্রভাবিত হচ্ছে সামাজিক কাঠামো, সাধারণ মানুষের প্রাপ্ত ক্ষমতা বা এজেন্সির কারণে সমাজের গতানুগতিক কাঠামোতেও আসছে পরিবর্তন।
সাম্প্রতিক সময়ে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া প্রভৃতি উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেখানে মানুষের প্রতিবাদ প্রকাশে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মূলধারার গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু শাসকরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোর মাধ্যমে বহু প্রতিবাদী মানুষের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ এবং বক্তব্য প্রকাশ বন্ধ করা রাষ্ট্রের জন্য কখনোই সহজ হয়নি। ভার্চুয়াল জগতে এমন যোগাযোগ এবং স্বাধীনভাবে সমালোচনা আর প্রতিবাদ প্রকাশের সুযোগ এই দেশগুলোর রাজপথে মানুষের সরাসরি আন্দোলন তীব্রতর করেছে। তিউনিসিয়ায় একজন দরিদ্র ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বোয়াজিজি তাঁর প্রতি কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার অন্যায় আচরণ আর অবহেলায় অপমানিত হয়ে নিজের শরীরে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহননের পর যে সরকারবিরোধী আন্দোলন সেখানে সূচিত হয়, তার প্রচণ্ডতায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেন আলির ২৩ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তিউনিসিয়ায় সেই আন্দোলনে আন্দোলনকারীরা নিজেদের প্রতিবাদ প্রকাশের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করেছিলেন ব্যাপকভাবে। মিসরের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘টুইটার আন্দোলন’ হিসেবেও। ইরানে ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল কেন্দ্র করে মানুষের যে প্রতিবাদ শুরু হয়, তখন রাজপথে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান নেদা আঘা-সুলতান নামের ২৬ বছর বয়সী দর্শনের এক ছাত্রী। ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষের মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করা গুলিবিদ্ধ নেদার রাস্তায় পড়ে থাকার দৃশ্য দ্রুত ফেসবুক আর ইউটিউবের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কেবল ইরানেই নয়, সারা বিশ্বেও। ইরানে সৃষ্টি হয় এক তীব্র প্রতিবাদ, বলা হয় ৩০ বছরের মধ্যে ইরান সরকারকে যে বিপদগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার অন্যতম একটি বিপদ হলো নেদার মৃত্যুর পর তৈরি হওয়া জনরোষ। ২০০৭ সালে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা চলাকালে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পাকিস্তানি সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বক্তব্য প্রকাশ করে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ প্রকাশের সক্ষমতা আর সুযোগের কারণে সুইডিশ রাজনীতিবিদ গুনিলা কার্লসন ফেসবুক আর টুইটারকে ‘টেকনোলজিস অব লিবারেশন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সনাতন গণমাধ্যম যদি প্রভাবশালীদের মতাদর্শ প্রচারের অস্ত্র হয়ে ওঠে, তাহলে নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের শোষণের বিরুদ্ধে নিজেদের চিন্তা এবং প্রতিবাদ প্রকাশের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে সমাজে আধিপত্যশীল মতাদর্শ বিরোধিতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিকরা বর্তমান সময়ে সক্রিয়ভাবে প্রকাশ করছেন তাঁদের মতামত আর চিন্তা। অনেকে মূলধারার গণমাধ্যমে লেখালেখি না করে, বরং বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক বা ইউটিউবের মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করতেই বেশি আগ্রহ বোধ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক ঘটনা যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অভাবনীয় সাফল্যের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন আমরা লক্ষ করেছি বহু মানুষের উচ্ছ্বাস, তেমনি একের পর এক ব্লগারদের কুপিয়ে হত্যা, পয়লা বৈশাখে নারীদের যৌন হয়রানি করা, সিলেটে রাজন আর খুলনায় রাকিব হত্যা, মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলার সময় একজন মা আর তাঁর গর্ভে থাকা সন্তান গুলিবিদ্ধ হওয়া প্রভৃতি নিন্দনীয় ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আমরা লক্ষ করেছি বহু মানুষের তীব্র সমালোচনা আর ক্ষোভ। শিশু রাজনকে নির্দয়ভাবে নির্যাতনের একটি ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক আর ইউটিউবে। এ দেশের কিছু মানুষ আজ কতটা অনুভূতিশূন্য আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে, তা প্রত্যক্ষ করে স্তম্ভিত আর আতঙ্কিত হয়েছে অজস্র মানুষ। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে মানুষ আজ বিভিন্ন অন্যায় এবং অন্যায় দমন করতে ব্যর্থতার সমালোচনায় মুখর হচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যমে অনেক মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় অন্যায় দেখে ক্ষুব্ধ মানুষ সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের প্রতিক্রিয়া আর নিন্দা প্রকাশ করতে পারছে। এই সক্ষমতার কারণে সাধারণ মানুষ গণমাধ্যম দর্শক হিসেবে আজ আর নিষ্ক্রিয় এবং জড় নয়। কোনো অন্যায় ঘটলে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দৃশ্যমান হচ্ছে বহু মানুষের প্রতিবাদী বক্তব্য।
তবে নতুন এই যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেমন মানুষের চিন্তা প্রকাশের সুযোগ তৈরি করেছে, তেমনি কখনো কিছু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছে তাঁদের কলুষিত ভাবনাও। কিছুদিন আগেই জাতীয় দলের ক্রিকেটার নাসির তাঁর বোনের সঙ্গে তোলা একটি ছবি ফেসবুকে আপলোড করলে সেখানে কিছু মানুষ নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করে, যার ফলে ব্যথিত নাসির ছবিটি ফেসবুক থেকে মুছে ফেলেন। ফেসবুক আর ইউটিউবে কখনো পোস্ট করা হচ্ছে বিভিন্ন আপত্তিকর আর অশালীন ভিডিও, কিছু মানুষ বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোয় প্রদান করছে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ এবং বিদ্বেষমূলক বক্তব্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় মুক্তচিন্তার মানুষ যেমন নিজেদের প্রগতিশীল এবং যুক্তিনির্ভর ভাবনা প্রকাশ করছেন, তেমনি বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাঁদের উগ্র বক্তব্যও তুলে ধরছে। কিন্তু মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধবিশ্বাস আর কলুষিত চিন্তা দূর করতে হলে সমাজে পুঁথিগত শিক্ষার পরিবর্তে সেই শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে, যা মানুষের মন আলোকিত, মুক্তচিন্তা নির্ভর এবং রুচিশীল করে তোলে।
কখনো কিছু মানুষ নেতিবাচক উদ্দেশ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করলেও নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর উপকারী দিকই বেশি। এখন সাধারণ মানুষ যেকোনো সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে স্বাধীনভাবে নিজের ভাবনা প্রকাশ করতে সক্ষম, যে সুযোগ পুরোনো গণমাধ্যমগুলোয় পাওয়া সহজ নয়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কোনো অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য পরিবেশিত হলে বহু মানুষ সরাসরিভাবে সেই বক্তব্যটির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো বিষয়ে বহু মানুষের বক্তব্য উঠে আসার কারণে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়, ফলে মানুষ সক্রিয়ভাবে একটি বক্তব্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা গ্রহণ বা বর্জন করে। এই সক্রিয়তা মানুষের মধ্যে তৈরি করে প্রয়োজনীয় সচেতনতাবোধ। মানুষ তাই আর প্রশ্নহীনভাবে কোনো বিষয় মেনে নিতে চায় না। প্রশ্ন এবং বিশ্লেষণ করার এই আগ্রহ থেকেই সৃষ্টি হয় নিষ্ক্রিয়তা, অন্ধতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতা। ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা প্রকাশের ক্ষমতার কারণে মানুষকে দমিয়ে রাখার পুরোনো রাজনৈতিক পদ্ধতি আর আগের মতো থাকে না। সোশ্যাল মিডিয়া তাই সংহত করে সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টির উদ্যোগ আর সম্ভাবনা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।