কোরিয়া সামিট
কিমকে কি বিশ্বাস করবেন মুন?
নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে দুই কোরিয়া, তাই সারা বিশ্বের নজর এখন কোরিয়ার ছোট্ট গ্রাম পানমুনজুমের দিকে। কী হচ্ছে, কী হবে এই নিয়ে শুধু কোরিয়া নয়, গোটা বিশ্বই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যেই দুই নেতা কোরিয়ান যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন, যা সত্যিই ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করি। আগ্রাসী মনোভাবের জন্য আলোচিত সমালোচিত উত্তর কোরীয় নেতা কিম জন উনের শারীরিক বাচনভঙ্গীও ছিল আজ যথেষ্ট মার্জিত ও আন্তরিক। যা সবার মনেই অনেকটা আশার সঞ্চার করেছে। তবে শত আশার ভিড়েও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন নগণ্য ছাত্র কিছু হতাশা মনের মাঝে বারবার উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে চুক্তি করেন, তখন একটি কথা বলেছিলেন, ‘বিশ্বাস করো, তবে যাচাই করে নিও।’ সকাল থেকে বিশ্ব মিডিয়াতে কোরিয়া সামিট দেখে রোনাল্ড রিগানের সেই কথাটি আবার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ার মতো বেশ কিছু কারণও আছে বৈকি।
সময়টা ছিল ২০০৭ সাল। আজকের মতো সেদিনও বিশ্বের চোখ ছিল কোরিয়া উপদ্বীপে, কারণ সেদিন বর্তমান কিম জং উনের বাবা ও উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম জং ইল সাক্ষাত করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোহ মু-হিউনের সাথে। সেবারও সবাই আশা করেছিলো, এবার বুঝি বন্ধ হবে দুই কোরিয়ার চলমান অঘোষিত যুদ্ধ। বৈঠক শেষে উত্তর কোরীয় প্রেসিডেন্ট এই মর্মে একমতও হয়েছিলেন যে, উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ করবে, বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়া মোটা অঙ্কের অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করবে উত্তর কোরিয়াকে। শুধু তাই-ই নয়, সেবার দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শান্তি চুক্তির খসড়াও স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তবে তার পরের ঘটনাটা সবার জানা। দুই কোরিয়ার পারস্পরিক দোষারোপে পুরো উদ্যোগটাই ভেস্তে যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহল অবশ্য এজন্য উত্তর কোরিয়াকে দায়ী করে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ করতে কখনোই আগ্রহী ছিল না। তারা যেটা করেছে, সেটা ছিল কেবলই লোক দেখানো ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়ার একটি কূটনৈতিক চাল মাত্র। তবে অনেকে এজন্য অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ার ভুল পদক্ষেপকেও দায়ী করে থাকে। তবে দোষ যারই হোক না কেন, ফলাফল ছিল ব্যর্থতা। ১৯৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধের পরে দুই কোরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়া ও পারমাণবিক অস্ত্রের নিরস্ত্রীকরণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ছিল ২০০০ সালের কোরিয়া সামিট। তবে শত আশা জাগানো সেই সামিটও শেষপর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
পরপর দুটি ব্যর্থ সামিটের কথা উল্লেখ করলাম, তবে এর মানে এই নয় যে, এবারের কোরিয়ান সামিটও ব্যর্থ হতে চলেছে। শত হতাশার ভিড়ে আমাদের সামনে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের মতো আশার আলো জাগানো উদাহরণও রয়েছে। তা ছাড়া আগামী মাসে হতে চলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কোরিয়ান নেতা কিম জং উনের বৈঠকের কারণেও এবারের সামিটটি অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সেজন্য এবার উত্তর কোরিয়াকে তার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে। উত্তর কোরিয়াকে প্রমাণ করতে হবে যে, ধারাবাহিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এড়াতে এটা তার নতুন কোনো কূটচাল নয়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কিম জং উনকে এখনো নতুন খেলোয়াড় বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ২০১১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তিনি এখন পর্যন্ত শুধু গত মাসে চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। বিশ্ব নেতাদের সাথে বৈঠক বলতে এখন পর্যন্ত এটি তার একমাত্র বৈঠক। তাই তার সম্পর্কে কিছু বলাটা বেশ কঠিন। তবে সমস্যা সমাধানে তিনি তার বাবার থেকে আরো বেশি অগ্রগামী ও উদারপন্থী হবেন বলে আশা রাখি। সম্প্রতি কোরিয়া সামিট নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, উত্তর কোরিয়া এবার তার পারমাণবিক অস্ত্র-পরীক্ষা বন্ধ করতে বদ্ধ্য পরিকর। যদি সত্যিই তাই হয়, তবে সেটি হবে পুরো কোরিয়াবাসী তথা বিশ্ববাসীর জন্য অত্যন্ত সুখকর বিষয়। তবে বাস্তববাদিতা ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে প্রেসিডেন্ট রিগান রোনাল্ডের কথাটির পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বাস করুণ, তবে যাচাই করে নিবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, উতরা বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া