ধনীর জাকাত, গরিবের মৃত্যু, দায় কার?
বড়লোকের জাকাত বিলাসের শিকার হয়ে প্রাণ গেল আরো অন্তত ৯ জনের। যাদের সবাই নারী। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় কবির স্টিল নামে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে জাকাত ও ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যু হয় তাদের। সোমবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৭-০৮ সালেও এই একই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পদদলিত ছয়জন নিহত হয়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, ১০ বছর আগের সেই ঘটনা থেকে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কোনো শিক্ষা নেননি। এতগুলো মানুষের মৃত্যুর দায় তিনি নেবেন কি না বা তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হবে কি না, তা আমরা জানি না।
অর্থনীতিতে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক আছে। অর্থাৎ একটি ভূখণ্ডে জনসংখ্যার আধিক্য বেড়ে গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাভাবে মানুষের মৃত্যু হবে বলে ওই তত্ত্বে বলা হয়। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট আয়তনের দেশে ১৬/১৭ কোটি মানুষ শুধু অস্বাভাবিকই নয়, এটি সামগ্রিক উন্নয়ন ও ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে কারণেই কি ইদানীং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বজ্রপাত আর সড়ক দুর্ঘটনাসহ পদদলিত হয়ে এভাবে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে? এই বন্দরনগরীতেই গত বছরের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম সিটির সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন।
প্রতি বছরই রোজা ও ঈদ সামনে রেখে আমাদের পয়সাওয়ালারা যেভাবে জাকাত বিলাস করেন, অনেক সময়ই তার ভিকটিম হয় গরিব মানুষ। আগের দিন মাইকিং করে এলাকায় ঘোষণা দেওয়া হয়, অমুক জনদরদি, গরিবের বন্ধু, বিশিষ্ট সমাজসেবক জাকাতের কাপড় দেবেন। ফলে দলে দলে মানুষ ছোটে। বাজারে জাকাতের কাপড় নামে একধরনের অতি নিম্নমানের শাড়ি ও লুঙ্গি পাওয়া যায়। দোকানেও সাইনবোর্ড ঝোলে, ‘এখানে জাকাতের কাপড় পাওয়া যায়’।
সেই অতি নিম্নমানের কাপড়, অথবা খেজুর-ছোলাসহ ইফতারের একটি প্যাকেট নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে হুলুস্থুল লাগে। তারপর এলোমেলো দৌড় শুরু হয়, নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা পায়ের নিচে পড়ে। চট্টগ্রামে এবারও যাদের মৃত্যু হলো, তাদের সবাই নারী।
এ রকম ঘটনা যখনই ঘটে, কয়েকটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। কিন্তু তারপরও এ রকম জাকাতের কাপড় বা সামান্য ইফতারি আনতে গিয়ে কেন মানুষের মৃত্যু হবে? এই ঘটনাগুলো কি আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে না? এ যাবত পদদলিত হয়ে এ রকম যত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো ঘটনায় কি হত্যা মামলা হয়েছে? যদি হয় তাহলে তার বিচার হয়েছে?
বড়লোকরা তাদের নিজেদের বড়লোকি জাহির করতে গিয়ে গরিব মানুষের প্রাণ নেবেন, এটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। একজন নাগরিক কিভাবে জনসাধারণের মধ্যে জাকাত বা ইফতার সামগ্রী বিতরণ করবেন, তার একটি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা থাকা দরকার। দেশে একটি জাকাত বোর্ড আছে, তারা আসলে কী কাজ করে, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়।
জাকাত ও ইফতার সামগ্রী যদি কেউ পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই দিয়ে থাকেন, তাহলে ঘটা করে মাইকিং করে বা আওয়াজ দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ডেকে দেওয়ার বিধান নেই। ইসলাম পরিষ্কারভাবে এটা বলে দিয়েছে যে, জাকাত দিতে হবে গোপনে। এ বছর যাকে জাকাত দেওয়া হবে, আগামী বছর যাতে তাকে আর জাকাত নিতে না হয়। কিন্তু আমাদের পয়সাওয়ালারা পাঁচ লাখ টাকা জাকাত হলে তিনি পুরো টাকা দিয়ে সস্তা শাড়ি লুঙ্গি কিনে কয়েকশো মানুষকে দেন। তারা মনে করেন, এতে অনেক মানুষ খুশি হয়। বস্তুত তারা যে মানের শাড়ি ও লুঙ্গি দেন, তা খুব দ্রুতই নষ্ট হয়। বরং ওই পাঁচ লাখ টাকা যদি তিনি তার পরিচিত পাঁচজন দরিদ্র মানুষ বা পরিবারকে দিয়ে কোনো একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে পরবর্তী বছর ওই পাঁচজনের জাকাত নিতে আসার কথা নয়। এভাবে দেশের এক হাজার বড়লোক যদি প্রতি বছর পাঁচ হাজার দরিদ্র লোককে জাকাত দিয়ে স্বাবলম্বী করেন, তাহলে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও বড় অগ্রগতি হয়। জাকাতের মূল উদ্দেশ্যই হলো দারিদ্র্য বিমোচন। কিন্তু আমাদের ধনীরা জাকাত দেন মূলত এলাকায় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রদর্শন আর ভোটের রাজনীতির জন্য। সুতরাং নিয়তেই যেখানে গলদ, সেখানে পদদলিত হয়ে নিরীহ মানুষের মৃত্যুই নিয়তি।
লেখক : সাংবাদিক