রাজনীতি
জঙ্গিকে ট্রাম্প কার্ড বানানো বন্ধ হোক!
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। যে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং বাকি ১০ ভাগ মানুষ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও তারা সবাই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সে দেশটিকে কেন আমরা জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি? স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাসহ অনেক বড় বড় ঘটনা দেশে ঘটেছে কিন্তু কখনো আমাদের এ শান্ত দেশটিকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করতে ব্যতিব্যস্ত হননি। তাহলে কেন স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে আমাদের দেশটিকে আমরা জঙ্গিরাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি?
স্বাধীনতা পরবর্তী বহু ঝড়ঝাপটা এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ৭৬-এর মনন্তরের সময়ও এ দেশের মানুষ তাদের বাস্তুভিটাকে আকড়ে ধরে কেবল বেঁচে থাকার লড়াই করে গেছে, সে সময়ও তো কোনো চরমপন্থা অবলম্বন করতে দেখা যায়নি। তাহলে আজ কেন এত হিংস্রতা? যে দেশটিকে একসময় বলা হতো তলা বিহীন ঝুড়ি সে দেশটি এখন অনেক দিক থেকে এগিয়ে। শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, অর্থনৈতিক ভাবে ক্রমবর্ধমান উন্নতিসহ নানা দিক থেকে আজ আমাদের দেশ স্বয়ংসম্পন্ন। যে দেশের মানুষ ভাতের অভাবে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর থাকত, সে দেশের মানুষের বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপি ১১৮০ মার্কিন ডলার। আয় ব্যয়সহ সব দিক থেকে আজ উন্নত। এত কিছু অর্জন, উন্নতি, জিডিপির হার বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রে যখন উন্নয়নের ছোয়া তখন কেন আমাদের এ জঙ্গি তকমা গায়ে লাগানো।
আমাদের দেশে জঙ্গি আছে— এ সন্দেহ আমার মনে হয় না, দেশের বেশির ভাগ মানুষও সেটা বিশ্বাস করে না। তাহলে কেন কোনো কিছু ঘটলে জঙ্গি জিকির শুরু করে দিয়ে মূল অপরাধীদেরকে আড়াল করার এ অপতৎপরতা? বিদেশি বেনিয়াদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জঙ্গি জিকিরে মুখে ফেনা তুলে আসল লাভটা কী? ক্ষমতার স্বার্থে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে আজ বিদেশের দেওয়া ছবক অনুযায়ী জঙ্গিরাষ্ট্র, জঙ্গিরাষ্ট্র বলে গলাবাজি করে দেশটিকে বিশ্বের দরবারে জঙ্গিরাষ্ট্র পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। আমরা কি জানি না, একটি মিথ্যা বারবার বলা হলে, সেটি সত্যে পরিণত হয়?
আজ হঠাৎ করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ইউটার্ন থেকে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের টনক নড়তে শুরু করেছে। যারা এত দিন জঙ্গিবাদের আস্তানা হিসেবে দেশটিকে পরিচয় করাতে উঠেপড়ে লেগেছিল তারাই এখন নতুন বাণী শুনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নতুন ভাবে সার্টিফাই করতে হচ্ছে- আমাদের দেশে কোনো জঙ্গি নাই। তাহলে আগে কেন ওসব কথা ছড়ানো হলো? সবই কি ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করার রসদ? প্রশ্ন রয়ে গেল, যখন দেখি টেকসই উন্নয় এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অসামান্য অবদান রাখায় আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মানসূচক জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ অর্জন করে তখন গর্বে আমাদের বুকের ছাতি ফুলিয়ে বলি আমরা বাঙালি। কিন্তু একই সময় যখন শুনি নিরাপত্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা মহিলা ক্রিকেট দলের আসন্ন সফর বাতিলের ঘোষণা তখন প্রধানমন্ত্রীর ওই পুরস্কারটা কতটা অর্থবহ হয় সেটি প্রশ্ন রয়েই যায়। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ঘোষাণা এবং ইটালিয়ান নাগরিক চেসারে তাভেলা, জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাকাণ্ড সবই কি এক সূতায় গাঁথা? একের পর এক বিভিন্ন দেশ থেকে রেড অ্যাল্যার্ট জারি, সে দেশের নাগরিকদের চলাফেরার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ, পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন দেশের সফর সূচি বাতিল— সব মিলিয়ে চরম ভাবে লজ্জিত করেছে বাংলাদেশকে।
বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছে অর্থনৈতিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যাওয়া এ দেশটিকে। মুহূর্তের মধ্যে ইমেজ সংকটে পড়তে হয়েছে এ দেশের মানুষকে। এ ঘোষণায় যতটা না ব্যথিত হয়েছে আমাদের দেশের মানুষ, তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছে আমাদের ক্রমবর্ধমান উন্নতি যাদের চক্ষুশূল সে সব রাষ্ট্র। টিম অস্ট্রেলিয়ার সফর বাতিলের ঘোষাণার সাথে সাথে নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি- আমরা কি পাকিস্তান হয়ে গেছি, হতে বসেছি কি আফগানিস্থান? সব কিছু যেন মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো হয়ে গেল।
মোড়লদের ব্লু-প্রিন্ট অনুযায়ী দেশে এখন চলছে জঙ্গি ট্রাম্প কার্ড খেলা। এ খেলা কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা কঠিন, তবে আঁচ করা যাচ্ছে— এটাই শেষ নয়। এখনই ভেবে দেখা উচিত আসলে আমাদের দেশে জঙ্গি আছে, না আমরা জঙ্গিবাদকে চাষ করতে চাচ্ছি? আমাদের উচিত হবে একটি ঘটনা ঘটার পরে তার প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করা। তা না করে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ-হাসিলের জন্য অন্যের ওপর দোষ চাপানোর যে প্রবণতা আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তাতে কেবল দেশের ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে আমার মনে হয় না। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়। রাজনৈতিক স্বার্থ নয় সর্বোপরি দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে বন্ধ করা উচিত জঙ্গি নিয়ে এ মরণ খেলা!
লেখক : সভাপতি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব।