৭ মার্চ
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
আটচল্লিশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুক্তিকামী বাঙালির জীবনে নিয়ে এসেছিল এক অবিনশ্বর সংগ্রামের দ্যোতিময় দিকনির্দেশনা। এই উর্বর ভূমির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উদাত্ত কণ্ঠে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। হাজার বছরের নিষ্পেষিত বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে এনে দিয়েছিল প্রাণের বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রক্তে লেখা সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি। আজ ৭ মার্চে তাঁর সেই ভরাট কণ্ঠ কি আমাদের আবারো ডাক দিয়ে যায়—মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া এবং এর প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিসংবলিত ’৬৬-এর ছয় দফা সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সত্তরের ৭ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। একাত্তরের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বেশি আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তোলেন। পরদিন বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বিবৃতি দেন, ‘ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।’
কিন্তু ভুট্টোর ওই দাবিতে তাল মিলিয়ে ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে সারাবাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পালিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। এর পথ ধরে স্বাধীনচেতা বাঙালির সামনে উপস্থিত হয় ৭ মার্চের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যেদিন বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা এড়িয়ে ২৩ বছরের পাকিস্তানি শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে কৌশলে স্বাধীনতার মন্ত্র ছড়িয়ে দেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার কিছুই করার থাকে না। ৭ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনার নামে ইয়াহিয়া ভুট্টো গং বাঙালির ওপর সামরিক নিপীড়নের ছক আঁকে। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে জান্তা সরকার বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার মায়ের বুক খালি করে। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুও সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন...।’ পরদিন জেনারেল ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন।
কিন্তু ততক্ষণে নতুন দেশের স্বপ্নে বিভোর বীর বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধকেই বরণ করে নিয়েছে। শান্তির বাংলায় মহাভারতের কুরুক্ষেত্র নামিয়ে দেওয়া পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধ্বাদের একটাই তখন পণ, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’।
ছয় দফা যদি হয় স্বাধীনতার বীজ রোপণ। ৭ মার্চের ভাষণ হলো সেই বীজের মন্ত্রণা। যে মন্ত্রে উদ্দীপ্ত বাঙালি স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণ ও সম্ভ্রম বাজি রাখতে কিঞ্চিৎ কুণ্ঠিতও হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদায়ী ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। জনসভায় উপস্থিত বিদ্রোহী জনতারা লাঠি, ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে উত্তপ্ত স্লোগানে মুখর ছিলেন। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে উচ্চারণ করলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’, লাখো মানুষের সমাবেশে নেমে এসেছিল পিনপতন নীরবতা। ভাষণের আগে বাসায় বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয়তমা সহধর্মিণীর পরামর্শ চেয়েছিলেন, আজ কী বলা যায়? প্রত্যুত্তরে বেগম মুজিব বলে দিয়েছিলেন, তুমি আজ কারো কথা শোনো না, তোমার মন যেদিকে সায় দেয় তুমি তা-ই বলো। বঙ্গবন্ধু নিজের অন্তরের দাবি মেনে ১৮ মিনিট ধরে ১১০৫ শব্দে বাঙালির মুক্তির নিখাদ তরিকা বাতলে দিয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবে ভাষণ শেষে ঢাকার অলিগলি স্বাধিকার চেতনায় জাগরণী স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠেছিল। মুক্তির আগুন জ্বলে ওঠেছিল বাংলা ভূমিতে। যেই আগুনের মহামহিম নির্বাণ ঘটে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে।
৭ মার্চের ভাষণের আগমুহূর্তে সমাবেশজুড়ে সমস্বর স্লোগানের ঝড় ওঠে। স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তারপর বঙ্গবন্ধু ট্র্যাজিক মহাকাব্যের সূচনা করেন : ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর অলিখিত ভাষণে পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের দুঃশাসনের বর্বর ইতিহাস জনগণকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালিকে গোলাম বানিয়ে পাকিস্তানি নিজেদের আখের গোছানোর বাস্তবতা সকলকে অনুধাবন করাতে চেয়েছিলেন। মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির দাবি তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু শঠ ও ধূর্ত পাকিস্তানিরা বাঙালিকে ঘৃণা ও ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন : ‘আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাঙলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো।’
তারপর বাঙালিকে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষাটাই দিতে হয়েছে। যেখানে রচিত হয়েছে ছেলেহারা মায়ের হাজার গল্পগাঁথা। সম্ভ্রমহারা বোনের করুণ উপাখ্যান। অশ্রুজলে লেখা হয়েছে স্বাধীনতার পৃথিবীশ্রেষ্ঠ শোকসংগীত।
প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছরের পুরোনো পৃথিবীতে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ তথা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য খুব বেশি নেই। জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো গুরুত্ব বিবেচনায় এযাবৎ মাত্র ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার (এমওডব্লিউ)-এ সংরক্ষণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এর মধ্যে অন্যতম। অবিস্মরণীয় ভাষণটি এখন বিশ্বস্বীকৃত অনন্য দলিল। বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের পাঠেরও অংশ এই ভাষণ।
কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর লেখা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় যথার্থই বলেন :
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : ‘কখন আসবে কবি?’
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : ‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।