স্থানীয় সরকার
দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক?
দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি ততই জমজমাট হয়ে উঠবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এরইমধ্যে আমরা জানি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হবে। কিন্তু সেটা কেন? দেশে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনা ও জৌলুশ লক্ষ করা যায়। পুরোমাত্রায় উৎসবের আমেজ থাকে এসব নির্বাচনে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ দেশের ‘লোকাল গভর্নমেন্ট ইলেকশন’ নির্দলীয় নয় দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাই হোক, ঐ সিদ্ধান্তের প্রতিফলন হিসেবে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয় স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংশোধন আইন। আইনগুলো হচ্ছে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) সংশোধন আইন ২০১৫, উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৫, জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন ২০১৫, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) সংশোধন আইন ২০১৫ এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০১৫। এই আইনের ফলে আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন উপযোগী ২৭৮টি পৌরসভার মধ্যে ২৪৫টিতে ভোট হবে, যদিও দেশে মোট পৌরসভা ৩২৩টি। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে ৪৮৮টি উপজেলা, ১১টি সিটি করপোরেশন, ৬৪টি জেলা পরিষদ এবং চার হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় পরিচয়ে ভোট হবে। আর এসব নির্বাচনে ব্যবহার হবে দলীয় প্রতীক।
যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তুলতে এবং স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি আরো শক্তিশালী করতে এ ব্যবস্থা বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকার অবশ্য ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ যে পৌরসভা নির্বাচন হবে সেটি দলীয়ভাবে হবে; এ জন্য আইনের সংশোধনকে ‘অধ্যাদেশ’ আকারে জারি করা হবে। আর সংসদের আগামী অধিবেশনে অধ্যাদেশগুলো আইন আকারে পাস হবে। সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এই আইন পাসে কোনো বাধা মোকাবিলা করতে হবে না আওয়ামী লীগের। যদিও বিএনপি গেল সোমবার দলীয়ভাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। দলের নেতারা বলেছেন,
সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে এই দলীয় নির্বাচন। এতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু সারা দেশে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থীরা আছেন। বিএনপির বিরোধিতার বড় কারণ হলো নতুন আইনে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট মেয়াদ পাঁচ বছর শেষ হওয়ার পর পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন প্রশাসক। যদিও আগের আইন অনুযায়ী মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আগের মেয়র বা চেয়ারম্যানই দায়িত্বে থাকেন। এখন নতুন আইনে বিএনপি-জামায়াতের চেয়ারম্যান, মেয়র ও ভাইস চেয়ারম্যানদের মেয়াদ শেষ হলেও নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসক দায়িত্বে থাকবেন। তাই বিএনপি নতুন এই আইনের বিরোধিতায় আদা-জল খেয়ে নেমেছে। যদিও তা ধোপে টিকবে না বলেই মনে হচ্ছে।
সুশীল সমাজও এই উদ্যোগের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা করছেন। এখন আসা যাক, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে কী কী সুবিধা হতে পারে :
১. বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সব সময় উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জনগনের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেবে; নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়বে।
২. ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে সে পদাঙ্ক অনুসরণ হলে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব।
৩. রাজনৈতিকভাবে নির্বাচন হলে জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়নের ধারা স্থানীয় পর্যায়ে সমুন্নত থাকার সম্ভাবনা থাকে; তাতে স্থানীয় জনপদ উপকৃত ও উন্নয়নের ছোঁয়া পায়।
৪. জাতীয় রাজনীতিতে কোনো একটি বিশেষ দল ক্ষমতায় থাকলে তারা চেষ্টা করবে সারা দেশে তাদের মত ও পথের বিস্তৃতি ঘটাতে। অর্থাৎ সারা দেশে দলটির নেটওয়ার্ক ছড়ানোর মাধ্যমে ক্ষমতা ছড়িয়ে যাবে।
৫. বর্তমান আইন অনুযায়ী নির্দলীয় নির্বাচন হলেও কেবল প্রতীকের বেলায় তা মানা হয়। অন্য সব কিছুতেই রাজনৈতিক আবহ থাকে। এমনকি প্রচারের বেলায়ও। তাই এই নির্বাচন দলীয় ব্যানারে করলে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
৬.তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন হবে এবং দেশে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে।
৭. দলীয়ভাবে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের ভিত্তি মজবুত হবে।
৮. স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য দলের ত্যাগী ও প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ের ভাষা বোঝেন যে সব রাজনীতিবিদ তাঁদের মনোনয়ন দিলে তৃণমূলে দল লাভবান হবে।
দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন করলে যেসব অসুবিধা হতে পারে :
১. রাজনৈতিকভাবে ‘স্থানীয় সরকার’ নির্বাচন হলে তৃণমূলে একটি বিশেষ দলের লোকজনের হাতে ক্ষমতা ও অর্থ থাকবে।
২. দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের অংশ নেওয়ার আগে মনোনয়নের দৌঁড়ে হানাহানিতে লিপ্ত হবে।
৩.এই আইন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারে, কারণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি।
৪. ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় সরকারকে গ্রাস করার আশঙ্কা থাকে।
৫. বাংলাদেশে আইনের শাসন না থাকায় নির্বাচনে আইন লঙ্ঘন হতে দেখা যায়।
৬. নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব বাড়বে যা গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
৭. প্রভাবশালী, অঢেল টাকার মালিকদের দলীয়ভাবে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে বের হয়ে আসার আশঙ্কা থাকে।
৮. সৎ, যোগ্য ও নিরীহ নির্দলীয় প্রার্থীরা অর্থ, বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে যাবে। ফলে, নির্বাচনের ফলাফল তাঁদের বিপক্ষে যেতে পারে।
৯. নির্বাচনকে কলঙ্কমুক্ত করতে সুশীল সমাজ ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। নতুন আইনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।
১০. জামায়াতের দলীয় গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় হাইকোর্টের রায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় পর এখন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০টি। এই দলের প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে পারবেন। তবে নির্বাচন কমিশনে অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোট যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে কি না সে বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে।
১১. দল সমর্থন দিলে ভোটে বিজয়ী জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করতে পারেন। কারণ, যে অর্থ খরচ করে তিনি বিজয়ী হবেন সেটা ওঠাতে হবে। এতে দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকে।
১২. নির্দলীয় নির্বাচন হলে সব মত-পথ ও দলের মানুষ যোগ্য প্রার্থীর জন্য কাজ করে। কিন্তু দলীয় নির্বাচন হলে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নানা রকম আবদার ও উন্নয়নমূলক কাজের নিলামে ভাগ বসানো থেকে নানা অপকর্ম চোখ-মুখ বুজে সহ্য করতে হবে; তা না হলে ভবিষ্যতে ওই তৃণমূল প্রতিনিধি ও নেতার পক্ষে কাজ করবে না কর্মীরা।
১৩. মনোনয়ন দেওয়ার সময় দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল বাড়লে নির্বাচনকেন্দ্রিক মামলার পরিমাণ বাড়বে।
১৪. প্রার্থিতা অযোগ্য ঘোষণা আবার বহাল রাখা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
১৫. নির্দলীয়, মেধাবী, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা দলীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার এই উদ্যোগ ইতিবাচক হলেও কিছু ব্যবস্থাপত্র এখনই হাতে রাখা দরকার। তা হলো :
১. রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনের উদ্যোগের পাশাপাশি দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মূল্যায়নের মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
২. স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন সর্বজনীন করতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি অন্য দল ও নিরপেক্ষ মানুষদের কাজে লাগাতে হবে; তা না হলে একপেশে কর্মকাণ্ড হবে।
৩. দলীয় নির্বাচন হলে একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন ও তৃণমূলে নেতৃত্বের বিকাশে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাদ পড়তে পারেন। তাই এটিকে সর্বজনীন করার বিকল্প নেই।
৪. ভোটের সময় সব দল, মত ও পথের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. দলের মনোনয়ন দেওয়ার সময় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে হবে।
৬. স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কাজের ভাগাভাগিতে অংশ নিতে গিয়ে দলীয় কোন্দল, সংঘাত ও প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
৭. তৃণমূলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে হবে; প্রয়োজনে দেশব্যাপী সাংগঠনিক ‘ক্যাম্পেইন’ ও ‘ওয়ার্কশপে’র ব্যবস্থা করতে হবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে।
৮. নির্বাচনী আচরণবিধি ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।
৯. রাজনৈতিক দল ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের চাপের ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচকে অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা হবে নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচে বড় চ্যালেঞ্জ।
১১. স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে সংঘাত বাড়ার আশঙ্কায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স ছাপাতে হবে।
১২. জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণে নির্বাচন বোর্ড গঠন করা জরুরি।
১৩. বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে মনোনয়নপত্র পেতে ১ থেকে ২ শতাংশ সমর্থক ভোটারের সমর্থন রাখার বিধান রাখলে মন্দ হয় না।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, আরটিভি