বিশ্বকাপ ক্রিকেট
আজ শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের পরাজয়ের পর চারদিকে এমন হাহাকার শুরু হলো, যেন সব শেষ হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়া দেখে আমি একটু চমকে গেছি। যাঁরা গেল গেল রব তুলছেন, তাঁরা কি আশা করেছিলেন, বাংলাদেশ বিশ্বকাপের সব ম্যাচ জিতবে? দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ইংল্যান্ডকেও হারিয়ে দেবে? আসলে আমাদের সব প্রত্যাশা বাস্তবতার নিরিখে হওয়া উচিত। প্রত্যাশা যদি অবাস্তব হয়, হতাশার বেদনা তখন তীব্র হবে। এটা ঠিক, গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা এবং তার পর থেকে স্বপ্নের মতো সময় কাটানো বাংলাদেশ এবার গেছে কমপক্ষে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে। আর সেমিফাইনালে উঠতে পারলে শিরোপা মাত্র দুই ম্যাচ দূরত্ব। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। ’৮৩-এর ভারত, ’৯২-এর পাকিস্তান, ’৯৬-এর শ্রীলঙ্কার চেয়ে এবারের বাংলাদেশ কম শক্তিশালী নয়। সেমিফাইনালে যাওয়ার হিসাবটাও কিন্তু পরিষ্কার। সেই হিসাবে কিন্তু ইংল্যান্ডকে হারানো ছিল না। হিসাবটা আবার ঝালিয়ে নিন।
এবার ফরম্যাট হলো ১০ দলের সবাই সবার সঙ্গে খেলবে। সেমিফাইনালে যেতে হলে কমপক্ষে পাঁচটি ম্যাচ জিততে হবে। ছয়টি জিতলে কোনো কথাই নেই। আবার হিসাব মিলিয়ে দেখুন, কোন কোন দলকে হারাতে চেয়েছিলেন আপনি। সাম্প্রতিক ফর্ম, পারফরম্যান্স বিবেচনায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কা ছিল আপনার প্রাথমিক টার্গেটে। এরপর কোনো একটা বড় দলকে হারাতে পারলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশ যদি সেমিফাইনালে নাও যায়, চারটি ম্যাচ জিতে, তাও তো আপনার সন্তুষ্ট থাকার কথা। তাহলে ইংল্যান্ডের কাছে হারার পর আপনি এমন হাহাকার করছেন কেন?
বিশ্বকাপের আগে ফিকশ্চার দেখে আপনি নিশ্চয়ই প্রথম তিন ম্যাচে জয়ের আশা করেননি। আপনার বিশ্বকাপ কিন্তু শুরু হওয়ার কথা চতুর্থ ম্যাচে, মানে আজ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় দিয়ে। আপনার সন্তুষ্ট থাকা উচিত যে আপনি বিশ্বকাপ শুরু করছেন বাড়তি এক জয় দিয়ে। বিশ্বকাপপূর্ব বিবেচনায় নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো ছিল না। একটা বোনাস জয় যেহেতু আছে হাতে, তাই আমরা বিশ্বকাপটা খেলতে পারব নিশ্চিন্তে।
ভাববেন না, বাংলাদেশ ইংল্যান্ডের কাছে হারায় আমার মন খারাপ হয়নি। আমারও মন খারাপ হয়েছে, তবে আমি হতাশায় নুয়ে পড়িনি। বাস্তবতার জমিনে পা রেখেই আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। পাকিস্তান প্রমাণ করেছিল, ইংল্যান্ড শক্তিশালী, কিন্তু অজেয় নয়। তবে আমাদের সঙ্গে ম্যাচটা এমন হয়েছিল, ইংল্যান্ড আগে ব্যাট করে ৩৮৬ রানের যে পাহাড় গড়েছিল, তা আমাদের জন্য অনতিক্রম্যই ছিল। তবে পরাজয়ের চেয়ে আমার কাছে খারাপ লেগেছে বাংলাদেশ দলের অ্যাটিচুডে। অনেক দিন পর বাংলাদেশ দল একটা ম্যাচ খেলতে নেমেছিল যেন হারার আগেই হেরে গিয়ে। রক্ষণাত্মক মানসিকতার প্রমাণ ছিল পরতে পরতে। টসে জিতে বোলিং নেওয়াটা দেখতে সাহসী সিদ্ধান্ত মনে হলেও সাকিবকে দিয়ে বোলিং ওপেন করিয়েই আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, পিচের সুবিধা নেওয়ার মতো বোলিং শক্তি আমাদের নেই।
মাশরাফি আর মুস্তাফিজ যদি চেষ্টা করতেন, তাহলেও ইতিবাচক মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যেত। দুদিন ঢেকে রাখা পিচে যেকোনো অধিনায়ক টসে জিতে বোলিং নিতে চাইবে। কিন্তু চাওয়ার মতো বোলিং শক্তি থাকতে হবে তো আপনার। বাংলাদেশ জানে, তাদের সেটা নেই। তারপরও বোলিং নেওয়া কেন? আসলে বাংলাদেশ দুদিন ঢেকে রাখা পিচে ইংলিশ বোলারদের সামনে পড়তে চায়নি। আগে ব্যাটিং করলে বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয় হতে পারত। সম্ভাব্য সেই লজ্জা আড়াল করতেই বাংলাদেশের বোলিং নেওয়া। মানসিকভাবে শুরুতেই আমরা হেরে বসেছিলাম। বোলিং নিয়েও সারাক্ষণ রক্ষণাত্মক মানসিকতায় খেলেছি। উইকেট নেওয়ার চেয়ে রান আটকে রাখার চেষ্টাটাই বেশি ছিল। এটা ঠিক, ইংল্যান্ডকে ৩৩০-এর ঘরে আটকে রাখতে পারলে খেলাটা অন্যরকম হতে পারতো।
তবে ইংল্যান্ডের মতো দলের রান আটকাতে হলে উইকেট লাগত শুরুতেই। ম্যাচজুড়েই বাংলাদেশের মানসিকতা ছিল আত্মসমর্পণের, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল হাল ছেড়ে দেওয়ার। আমার বেশি খারাপ লেগেছে সেটাই। সেই খুনে মেজাজটা পাইনি। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও কিন্তু আমরা ফাইট দিয়েছি। তৃতীয় ম্যাচে সেই ফাইটিং স্পিরিটটা পাইনি বলেই মনটা খারাপ। রক্ষণাত্মক খেলে আপনি হেরেছেন। আক্রমণাত্মক খেলেও হারতে পারতেন। তবে দুই পরাজয়ে পার্থক্য থাকত অনেক। ক্রিকেট অনেকটাই মানসিকতার খেলা।
একটা জিনিস পরিষ্কার, বাংলাদেশকে জিততে হলে, সেমিফাইনালে যেতে হলে বোলিংয়ের ধার আরো বাড়াতে হবে। এই সময়ে তো আর আপনি বোলার বানাতে পারবেন না, স্কোয়াডে যা অস্ত্র আছে, তাই নিয়ে লড়াই করতে হবে। উইনিং কম্বিনেশন না ভাঙার দোহাই দিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অপরিবর্তিত দল নিয়ে মাঠে নামলেন ঠিক আছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিজ্ঞ রুবেলকে ছাড়া মাঠে নামলেন কেন আপনি। ১১ জন ব্যাটসম্যান দিয়ে কিন্তু ম্যাচ জেতা যায় না। ম্যাচ জেতাতে চাই বোলিং। আজকের ম্যাচে তাই রুবেলের অন্তর্ভুক্তিটা জরুরি। রুবেল কার জায়গায় খেলবেন? আমার হিসাবে সাইফউদ্দিনের জায়গায় রুবেল অনায়াসে ঢুকে যেতে পারেন। অনেকে সাইফউদ্দিনের ব্যাটিং সামর্থ্যকে বিবেচনায় নিতে চাইছেন। কিন্তু সাইফউদ্দিন ছাড়াও তো দলে আপনার আটজন ব্যাটসম্যান আছে। সেই আটজন না পারলে সাইফউদ্দিন আপনাকে ম্যাচ জেতাবে? সাইফউদ্দিনের ক্ষেত্রে আপনার বোলিংটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে রুবেল এগিয়ে থাকবেন। বোলিং যদি আরো শক্তিশালী চান, তবে মিঠুনের বদলে রুবেলকে নিতে পারেন।
মিঠুনের অনুপস্থিতি ব্যাটিং যতটা দুর্বল করবে, সাইফউদ্দিন তা পুষিয়ে দিতে পারবেন। তবে আমার বিবেচনায় সাইফউদ্দিনের জায়গায় রুবেল আর মিঠুনের জায়গায় লিটন দাসকে নেওয়া যেতে পারে। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল জিতিয়ে হঠাৎ একাদশে ঢুকে পড়া মোসাদ্দেককে দলে জায়গা ধরে রাখতে হলে আরো চমক দেখাতে হবে। তবে যারা মাশরাফির জায়গায় রুবেলকে নিতে চান, তাদের জন্য একসাগর করুণা।
বাংলাদেশের ব্যাটিং গভীরতাটা আমরা জানি, বোলিং দুর্বলতাটাও জানি। বোলিং ঘাটতিটা পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল ফিল্ডিংয়ে। কিন্তু প্রথম তিন ম্যাচেই আমরা সেটা পারিনি। উল্টো প্রতিপক্ষকে বাড়তি ৩০/৪০ রান দিয়েছি, যেটা পরে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হয়ে গেছে। আগেও বলেছি, আবারও বলছি সেমিফাইনালে যেতে হলে নিশ্ছিদ্র ফিল্ডিং লাগবে। রাতারাতি আপনি বোলিং বদলাতে পারবেন না, কিন্তু ফিল্ডিয়ে জান দিয়ে লড়তে পারবেন। বিশ্বকাপে গা বাঁচিয়ে খেলার সুযোগ নেই। মিরাজের মতো সবাইকে লড়তে হবে শেষবিন্দু পর্যন্ত। ফিল্ডিংটা অনেকটাই অ্যাটিচুডনির্ভর। আপনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বদলে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য। আমি সবসময় বলি, বাংলাদেশ সব ম্যাচ জিতবে, এমনটা আমি আশা করি না। আমি খালি চাই, অদম্য মানসিকতা, জয়ের চেষ্টা।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যেটা ছিল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেটা পাইনি।
আপনাদের সবার মতো আমিও জানি আজ বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে, জয়ের ধারায় ফিরবে। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান তো আছেনই, ফর্মে আছেন মুশফিকও। এখন অপেক্ষা তামিম ইকবালের জ্বলে ওঠা। সৌম্যকেও শুধু ঝলক দেখালে হবে না, বড় ইনিংস খেলতে হবে। গত বিশ্বকাপে পরপর দুটি সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহ এবার এখনো ঘুমিয়ে আছেন। ছয় নম্বরে নেমে সেট হওয়ার জন্য অনেক সময় নেন, আর সেট হয়ে আউট হয়ে যান। আগের লেখায় লিখেছি, আবারও দাবি করছি, মাহমুদুল্লাহকে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করার সুযোগ দেয়া হোক।
বিশ্বকাপ এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, এখানে ভুল করার সুযোগ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিশ্বকাপ অর্ধেক হওয়ার আগেই প্রায় শেষ। তাই বাংলাদেশকে সাবধান থাকতে হবে। কোনো ভুল করা যাবে না। ব্যাটিং গভীরতাটা আমরা জানি। বোলিং দুর্বলতাটা মাথায় রেখেই লড়াই করতে হবে। আর জান দিয়ে লড়তে হবে ফিল্ডিয়ে। আজ লঙ্কা-বধ দিয়েই তবে শুরু হোক বাংলাদেশের আসল বিশ্বকাপ, সেমিফাইনালযাত্রা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।